
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা এবং ব্যবহার না করার কারণে শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং লাইফস্টাইলে যে পার্থক্য সৃষ্টি হয় তাকেই ডিজিটাল ডিভাইড বলা হয়।
অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইড বলতে সাধারণভাবে কোন সমাজের অভ্যন্তরে অথবা দুই বা ততোধিক সমাজের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অসম বন্টনকে বোঝানো হয়। একটি শ্রেণীর শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতা উন্নত হওয়ায় তারা তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ্যার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কার্যকরীভাবে ব্যবহার করছে, কিন্তু অন্য শ্রেণীটি তা পারছে না তাই অনেকে সংক্ষেপে বিভিন্ন দল বা সমাজভেদে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার ও ব্যবহারের মাত্রার তারতম্যকেই ডিজিটাল ডিভাইড হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা এবং ব্যবহার না করার কারণে শিক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং লাইফস্টাইলে যে পার্থক্য সৃষ্টি হয় তাকেই ডিজিটাল ডিভাইড বলা হয়।
Paul (2002)- এর মতে, "Digital Divide' refers to the unique and disproportionate pace of development in societies in having access to digital infrastructure and service."
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতিগত, লিঙ্গগত, ধর্মীয় ও অন্যান্য সব ধরনের বৈষম্যের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল ডিভাইডও বৈষম্যের একটি নতুন মাত্রা হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অর্থবিত্ত বা সামাজিক প্রভাব থাকার ফলে একদল মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটে, আর এগুলো না থাকার ফলে অন্য একদল মানুষ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, ফলে সৃষ্টি হয় বৈষম্যের। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ ও দক্ষতা থাকা বা না থাকার উপর ভিত্তি করেও এরকম বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে উন্নত দেশগুলি সর্বাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলি অনেক ক্ষেত্রে সেসব সুবিধা পাচ্ছে না, কিংবা তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তিগুলি অত্যন্ত পুরোনো। এর ফলে বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসবাসকারী লোকজনের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। ফলে এক জনগোষ্ঠী আরেক জনগোষ্ঠী থেকে প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
১৯৯০ -এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে 'ডিজিটাল ডিভাইড' শব্দটি প্রথম প্রচলন করেন Clarence "Larry" Irving Jr. যিনি ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের (Department of Commerce) 'জাতীয় টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রশাসন' (National Telecommunications and Information Administration, NTIA) নামক সংস্থার প্রধান হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিশেষত ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে "Falling Through the net: A Survey of the 'Have Nots' in Rural and Urban America" নামক একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে অভিবাসী, জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বয়স্ক নারী-পুরুষ, দরিদ্র জনগোষ্ঠী, গ্রামে বসবাসকারী এবং অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতদের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সেই তুলনায় স্থানীয় অধিবাসী, জাতিগত, বর্ণগত ও ধর্মীয় সংখ্যাগুরু, তরুণ-তরুণী, বিত্তশালী, শহুরে এবং উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি। তদুপরি সামগ্রিকভাবে পুরুষদের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা নারীদের তুলনায় বেশি। এই সমস্ত বিষয়গুলি 'ডিজিটাল ডিভাইড' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ডিজিটাল ডিভাইডের স্তর-
যাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (বিশেষত ইন্টারনেট) ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে এবং যাদের সেই সুযোগ নেই তাদের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইড রয়েছে। আবার যাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে যারা এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশি দক্ষ আর যারা তুলনামূলকভাবে কম দক্ষ তাদের মধ্যেও ডিজিটাল ডিভাইড রয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ডিজিটাল ডিভাইড কে দুটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমটি হল প্রবেশাধিকার (Access) সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি ব্যবহার (Usage) সংক্রান্ত।
ধরা যাক কেয়া ও সঞ্চালী দুজন শিক্ষার্থী তাদের মধ্যে কেয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে কিন্তু সঞ্চালীর সেই সুযোগ নেই। অর্থাৎ কেয়া ও সঞ্চালীর মধ্যে একটি ডিজিটাল ডিভাইড বিদ্যমান, যেটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ (access) সংক্রান্ত।
আবার রাম এবং রহিম দুজন চাকরিজীবী। দুজনেরই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে কিন্তু এদের মধ্যে রাম ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ এবং তার চাকরির কাজে ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করে, অন্যদিকে রহিম ইন্টারনেট ব্যবহারে রামের চেয়ে কম দক্ষ এবং মূলত বিনোদন লাভের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে রাম ও রহিমের মধ্যেও ডিজিটাল ডিভাইড রয়েছে। তাদের মধ্যেকার ডিজিটাল ডিভাইড সুযোগ (access) সংক্রান্ত নয় বরং ব্যবহার (usage) সংক্রান্ত।
ডিজিটাল ডিভাইড এর ধরন-
ডিজিটাল ডিভাইড সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন- সামাজিক (Social), বৈশ্বিক (Global) এবং গণতান্ত্রিক (Democratic)। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকের ভিত্তিতে বিভক্ত বিভিন্ন দলের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ ও দক্ষতায় তারতম্য থাকে। এটিকে সামাজিক ডিজিটাল ডিভাইড বলা হয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে জাতিগত, ধর্মীয়, লিঙ্গগত ও বর্ণগত পরিচিতি, শিক্ষার মান, আয়ের পরিমাণ, বয়স, পারিবারিক এবং বাসস্থান সংক্রান্ত পার্থক্য।
বিশ্বের মানচিত্রে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহ এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও ডিজিটাল ডিভাইড রয়েছে। যেমন ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী শিল্পোন্নত আমেরিকায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯১.২%, অন্যদিকে আমাদের ভারতবর্ষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫৮.৬%। অর্থাৎ শিল্পোন্নত আমেরিকায এবং উন্নয়নশীল ভারতবর্ষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এটি হচ্ছে বৈশ্বিক ডিজিটাল ডিভাইডের নমুনা।
আবার দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যদি একটি রাষ্ট্রের অধিবাসীরা অন্য রাষ্ট্রটির অধিবাসীদের তুলনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বেশি ব্যবহার করে তবে তাদের মধ্যেও গণতান্ত্রিক ডিজিটাল ডিভাইড বিদ্যমান। যেমন ফ্রান্সের অধিবাসীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে যে হারে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সৌদি আরবের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে সেটির হার অনেক কম। এটি হল গণতান্ত্রিক ডিজিটাল ডিভাইড।
ডিজিটাল ডিভাইডের পর্যায়সমূহঃ-
- Economic divide
- Usability divide
- Empowerment divide.
১৯৯০-এর দশক পেরিয়ে বিশ্ব ২০২০-এর দশকে পা রেখেছে কিন্তু বৈশ্বিক ডিজিটাল ডিভাইড বহুলাংশে স্থিতিশীল রয়েছে। অর্থাৎ শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইড এখনো প্রায় একইরকম রয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলিতে সামাজিক ডিজিটাল ডিভাইড হ্রাস পেয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলিতে নারী ও পুরুষদের মধ্যে এবং গ্রাম ও শহরের আদিবাসীদের মধ্যে যে ডিজিটাল ডিভাইড ছিল সেটি অনেকটাই কমে গেছে, কিন্তু বয়স, শিক্ষার মান এবং জাতিগত ও বর্ণগত পরিচিতির কারণে যে ডিজিটাল ডিভাইড সৃষ্টি হয়েছে সেটির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ ডিজিটাল ডিভাইড শব্দগুচ্ছটির ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁদের মতে ডিজিটাল ডিভাইড শব্দটি দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহার 'করতে পারে' এবং 'করতে পারে না' এরকম দুটি শ্রেণীর সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণীদুটি নির্ধারিত নয়। বরং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের সুযোগ ও দক্ষতার মাত্রা বিভিন্ন রকম। এজন্য 'Digital Divide' -এর পরিবর্তে 'Digital Inequality' বা ডিজিটাল অসমতা শব্দগুচ্ছটি ব্যাবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন।
ডিজিটাল ডিভাইড হ্রাসের উপায় সমূহঃ-
ডিজিটাল ডিভাইড কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে-
১) অবকাঠামোগত উন্নতি সাধন করতে হবে।
২) দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতে ICT-র সুবিধা বিস্তৃত করা যায় সেই লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করতে হবে।
৩) কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিসম্পন্ন দ্রব্যের পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
৪) সরকারের পক্ষ থেকে এই সংক্রান্ত বিভিন্ন রকমের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
৫) উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
0 Comments: