
আদর্শ ভাষা বনাম গৃহভাষাশক্তির সচলতা (Power dynamics of Standard language vs Home language)
আদর্শ ভাষা :
আদর্শ ভাষা বলতে কোন বিশেষ উপভাষার পরিশীলিত রূপকে বোঝায়, যেটি অধিক সংখ্যক শিক্ষিত ও সভ্য মানুষ নির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্যবহার করে থাকে। বহু মানুষের একই রকম প্রয়োজন ও একই রকম চিন্তাধারা থেকে আদর্শ ভাষার জন্ম হয়।
কোন দেশ বা শহরের অথবা রাজধানীতে বসবাসকারী শিক্ষিত, ভদ্র ও সভ্য মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন সেটাকেই আদর্শ ভাষা বলা হয়। অর্থাৎ রাজধানীতে বসবাসকারী সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের মার্জিত ভাষাই হল আদর্শ ভাষা।
গৃহভাষা :
শিক্ষা, পরিবেশ, সংস্কৃতি ও বংশগত ঐতিহ্যের তারতম্যের কারণে একই ভাষার অন্তর্গত বিভিন্ন পরিবার বা গৃহে বিভিন্নরকম ভাবে কথা বলার রীতি প্রচলিত রয়েছে। তাই শিশু যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবারের কথা বলার ভঙ্গিমা সে অনুকরণ করতে থাকে।
শিশু যে গৃহে জন্মগ্রহণ করে এবং যে গৃহের ব্যক্তিবর্গ অর্থাৎ মা, বাবা, আত্মীয়-পরিজন প্রমুখের কাছ থেকে সে যে ভাষা শেখে এবং ভাষা প্রয়োগের যে ভঙ্গিমা বা শৈলী আয়ত্ত করে এবং যার মাধ্যমে সে বাবা, মা, আত্মীয়-পরিজনের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করে সেটাই হলো তার গৃহভাষা।
ভাষার গুরুত্ব আলোচনার নিরীখে আমরা বলতে পারি গৃহভাষার মধ্যে যে কোন পরিবারের সংস্কার, ধর্ম প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যক্তি কোন্ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তার পরিচয় বহন করে গৃহভাষা। গৃহভাষাই প্রকৃতপক্ষে যে কোন শিশুর মাতৃভাষা। তাই মানবজীবনে গৃহভাষার গুরুত্ব অনেক। আবার অন্যদিকে দেখতে গেলে গৃহভাষা যতই ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের সহায়ক হোক না কেন সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে ব্যক্তিকে আদর্শ ভাষার প্রয়োজন অনুভব করতেই হয়। তাই আদর্শ ভাষার গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়।
আদর্শ ভাষা ও গৃহভাষার সম্পর্ক-
আদর্শ ভাষা ও গৃহভাষা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং উভয়ের মধ্যে নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন-
১) আদর্শ ভাষা যেকোন গৃহভাষারই মার্জিত ও পরিশীলিত রূপ।
২) গৃহভাষা ব্যবহারকারী মানুষজন আদর্শ ভাষাকেই লিখিত আকারে ব্যবহার করে।
৩) এমন কিছু শব্দ বা বাক্য আছে যেগুলি দুটি ভাষাতেই ব্যবহার করা যায়।
৪) আদর্শ ভাষা হল সমাজ ও দেশের মেরুদন্ড আর গৃহভাষা হল সেই সমাজ ও দেশের বিভিন্ন গৃহের ব্যক্তিবর্গের ব্যবহার্য ভাষা।
৫) আদর্শ ভাষার সঙ্গে গৃহভাষার সম্পর্ক সমগ্রের সঙ্গে অংশের সম্পর্কের মত।
আদর্শ ভাষা ও গৃহভাষার পার্থক্য-
আদর্শ ভাষা ও গৃহভাষা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তবুও তাদের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। আর এই পার্থক্যের জন্যই দুটি পৃথক ধারণা তৈরি হয়েছে। পার্থক্যগুলি নিম্নরূপ-
i) শিশু আদর্শ ভাষা সাধারণত বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের কাছ থেকে শেখে, কিন্তু গৃহভাষা পরিবারের ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকেই শেখা যায়।
ii) আদর্শ ভাষার ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ, সেই তুলনায় গৃহ ভাষার পরিসর অনেকটাই সংকীর্ণ।
iii) আদর্শ ভাষার রূপ লিখিত এবং মৌখিক দুটোই হতে পারে কিন্তু গৃহ ভাষার কেবলমাত্র মৌখিক রূপই ব্যবহৃত হয়।
iv) আদর্শ ভাষায় ব্যাকরণগত নিয়ম রয়েছে কিন্তু গৃহভাষা কোন নিয়ম মেনে চলে না।
v) আদর্শ ভাষা যেকোন ভাষার মার্জিত ও পরিশীলিত রূপ, কিন্তু গৃহভাষা যেকোনো ভাষার সাধারণ রূপ।
vi) আদর্শ ভাষা শিক্ষিত, সভ্য ও শহরের মানুষজন ব্যবহার করে, কিন্তু গৃহভাষা যে কেউ ব্যবহার করতে পারে।
vii) আদর্শ ভাষাশিক্ষা সম্পূর্ণরূপে অর্জিত, অপরদিকে গৃহভাষাশিক্ষা একেবারেই সহজাত।
viii) আদর্শ ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়, কিন্তু গৃহভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচিত হয় না তবে সাহিত্যক্ষেত্রে উক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ix) আদর্শ ভাষা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটায়, অপরপক্ষে গৃহভাষা মানসিক তৃপ্তি ও মানসিক উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করে।
x) আদর্শ ভাষায় কোন আঞ্চলিকতার প্রভাব থাকে না, কিন্তু গৃহভাষায় মুদ্রাদোষ, টান ও আঞ্চলিকতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
আদর্শ ভাষা ও গৃহ ভাষার মধ্যে সম্পর্ক যেমন আছে তেমনি পার্থক্যও রয়েছে। তবে এই পার্থক্য নিতান্তই গৌণ। প্রয়োজনের দিক থেকে দুটো ভাষাই ব্যক্তির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবজীবনে দুটি ভাষারই সমান প্রভাব রয়েছে। তাই এদের কোনটিকেই আমরা অবহেলা করতে পারি না।
0 Comments: