.jpeg)
শিক্ষা কাকে বলে? শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি কী কী?
শিক্ষার অর্থ-
শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়তা করে, কুসংস্কার মুক্ত করে, উদার করে, মার্জিত করে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এককথায় দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
শিক্ষা শব্দের ব্যুৎপত্তি-
শিক্ষা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত 'শাস্' ধাতু থেকে। যার অর্থ হল শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্দেশ দান করা। আবার শিক্ষা শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বিদ্যা। বিদ্যা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'বিদ্' ধাতু থেকে। যার অর্থ হল জ্ঞান অর্জন করা বা জানা। শিক্ষা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Education শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ educare অথবা educere থেকে। এখানে educare শব্দের অর্থ হলো – to train (প্রশিক্ষিত করা) এবং to accustom (অভ্যস্ত করা)। কেউ কেউ বলে থাকেন educare এর আরেকটি অর্থ – to bring up (লালন-পালন করা)।
অন্যদিকে educere শব্দের অর্থ হল – to lead out বা বের করে আনা। এখানে ‘বের করে আনা’ মানে হলো সুপ্ত মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানো। education এর উৎপত্তি educere থেকে হয়েছে এটি খুব বেশি মানুষ বিশ্বাস না করলেও, কেউই একে বাদ দিয়ে কথা বলতে পারেন না।
আবার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, education শব্দটি সরাসরি educare থেকে আসেনি। মাঝখানে পার হতে হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। ল্যাটিন educare থেকে আমরা বেশ কিছু শব্দের জন্ম সম্পর্কে জানতে পারি। এদের মধ্যে educat এবং educatio ল্যাটিন শব্দ, এখান থেকে একইসঙ্গে ইংরেজি শব্দের educate (কাউকে শেখানো) এর উৎপত্তি হয়। এভাবেই ষোড়শ শতাব্দিতে ইংরেজি শব্দ Education উৎপত্তিলাভ করে।
সাধারণ অর্থে শিক্ষা-
মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অনেক কিছুই শেখে। কোন ব্যক্তি যা কিছু শেখে তাকেই আমরা ‘শিক্ষা’ হিসেবে অভিহিত করতে পারি। এটি হল শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা। সমাজের প্রতিটি মানুষই শিক্ষিত কারণ শিক্ষার সাধারণ ধারণা অনুসারে প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু জানে বা পারে।
ব্যাপক অর্থে শিক্ষা-
সাধারণ অর্থে শিক্ষার ধারণা এবং ব্যাপক শিক্ষার ধারণা মূলত একই। শিশুর যখন জন্ম হয় তখন থেকেই সে তার পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিতে থাকে এবং শিক্ষা নেওয়ার ফলে আচরণগত পরিবর্তন হয়। শিক্ষা হল মানবীয় প্রচেষ্টার একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যা কোন না কোন বাস্তব সমস্যার সমাধানকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণা-
বিশেষ অর্থে শিক্ষার ধারণাকে আমরা শিক্ষার সংকীর্ণ ধারণাও বলতে পারি। শিক্ষা (education) নিয়ে সর্বদা যে আলোচনা হয় বা আমরা যে অর্থে শিক্ষা শব্দটিকে ব্যবহার করি তা বিশেষ বা সংকীর্ণ অর্থেই ব্যবহার করি। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাই হল শিক্ষার বিশেষ বা সংকীর্ণ ধারণার রুপ। বিশেষ অর্থে শিক্ষা হলো স্বীকৃত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা বিষয়সমূহে জ্ঞানার্জন করা। যারা বিদ্যালয় কিংবা পাঠশালা থেকে পড়া, লেখা ও গণিতের প্রাথমিক ধারণালাভ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত হয়েছেন তাঁরাই শিক্ষার বিশেষ অর্থ অনুযায়ী শিক্ষিত।
শিক্ষা সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদের মতবাদ-
প্লেটো শিক্ষাকে সনাক্ত করেছেন ন্যায় বিচার অর্জনের উপায় হিসেবে। তিনি বলেছেন, “শিক্ষা হল ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায়বিচার উভয়ই অর্জনের উপায়”।
অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”।
জন ডিউই How We Think বইয়ে লিখেছেন, "শিক্ষা হল জীবনযাপনের প্রক্রিয়া, তবে ভবিষ্যতে জীবনযাপনের প্রস্তুতি নয়"।
এফ. জে. ব্রাউন শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “শিক্ষা এমন একটি প্রক্রিয়া যা কারও জন্ম থেকে শুরু হয়ে জীবনব্যাপী চলতে থাকে। শিক্ষাই জীবন, পুরোটা জীবনই শিক্ষা”।
বি. এফ. স্কিনার বলেছেন, “শিক্ষা মানে বৃদ্ধি আর বৃদ্ধি মানে হলো বহুমুখী বিকাশ”।
জোহান হেনরিখ পেস্তালৎজির মতে, “শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির স্বাভাবিক, সুষম ও প্রগতিশীল বিকাশ”।
জন ফ্রেডারিক হার্বার্ট বলেছেন, “মানুষের নৈতিক চরিত্রের বিকাশ সাধন হল শিক্ষা”।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “শিক্ষা হল মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ”।
আধুনিক শিক্ষা কী?
যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদিকে গুরুত্ব প্রদান করে প্রগতিশীল সমাজ ও বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে তোলা যায় সেই প্রক্রিয়াকে আধুনিক শিক্ষা বলা হয়। আধুনিক শিক্ষা একটি শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক প্রক্রিয়া; এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করা হয়।
সকল প্রকার আলোচনার নির্যাস হিসেবে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা একজন মানুষের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করে। এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং এর মাধ্যমে মানুষের আচরণের পরিবর্তন হয়।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-
শিক্ষার ধারণা যেমন নির্দিষ্ট কোনো রূপ লাভ করতে পারেনি, তেমনই শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েও রয়েছে নানান মতামত। যুগে যুগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ধরন পাল্টেছে। দেশ, জনগোষ্ঠী, বিশ্বাস, রীতিনীতি কিংবা প্রয়োজনের দিক বিবেচনা করলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থ্যক্য দেখা যায়। এখানে শিক্ষার বেশ কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হল-
১) শিক্ষার জ্ঞানার্জনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল জ্ঞানার্জন করা। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের বিভিন্ন দিকে দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের চিন্তাশক্তির বিকাশলাভ তখনই সম্ভব হয় যখন সে কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে। জ্ঞান অর্জন করলে যেমন ব্যক্তির মানসিক উন্নতি হয় তেমনই ব্যবহারিক দিকেরও উন্নতি হয়। জ্ঞানকে শুধু জানার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ‘প্রকৃত জ্ঞান’ প্রত্যয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সক্রেটিস, ফ্র্যান্সিস বেকন, ফ্রয়েবল, বেঞ্জামিন ব্লুম কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সবাই জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল জ্ঞানার্জন করা একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।
২) শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- আধুনিক বিশ্বে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল মানবসম্পদ তৈরি ও মানবসম্পদের উন্নয়ন। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আলাদা করে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আগমন, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানে প্রবেশের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বৃত্তিমূলক বা কর্মমূখী শিক্ষাকে ‘bread and butter aim of education’ বা ‘শিক্ষার রুজি লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করে থাকেন অনেকে। মানুষের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন হলেও তা যথাযথ বৃত্তিমূলক বা কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া প্রায় মূল্যহীন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাই পারে ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে।
৩) শিক্ষার সামাজিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল সেটা নয় যা ব্যক্তিকে নিজের মধ্যে বা গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। আত্মকেন্দ্রিক মানুষ খুব সহজেই সমাজচ্যুত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং মানুষ সামাজিক জীব আর শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষকে সামাজিক দক্ষতায় দক্ষ করে সমাজের সক্রিয় অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলা। সামাজিক দক্ষতা বলতে এখানে সমাজে সকলের সঙ্গে আনন্দের সাথে বসবাসের জন্য সমাজের সদস্যদের সাথে আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্ক স্থাপন, নৈতিক ও আচরণগত জ্ঞান, সাংস্কৃতিক জ্ঞান, সমাজ সচেতনতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য অর্জনসহ যে অত্যাবশ্যকীয় সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রয়োজন সেগুলির সমষ্টিকে বোঝান হয়। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও সমাজবিদগণ ব্যক্তির সামাজিক দক্ষতার উন্নয়নকে আধুনিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
৪) শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- নির্দিষ্ট সমাজে বসবাসরত লোকজনের আচার-আচরণ, আদর্শ, জ্ঞান, কলাকৌশল, দক্ষতা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অভ্যাস ইত্যাদির সমষ্টিকে সংস্কৃতি বলা হয়। সংস্কৃতি হল সমাজবদ্ধ মানুষের পরিপূর্ণ জীবনচিত্র। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষ পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উত্তরাধিকারস্বরূপ পেয়ে থাকে।
যথাযথ সাংস্কৃতিক জ্ঞান না থাকার কারণে যে কেউ পিছিয়ে থাকতে পারে। সাংস্কৃতিক জ্ঞানের অভাব দূর করতে পারে একমাত্র শিক্ষা। শিক্ষার সাংস্কৃতিক লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে সত্যের পূজারী করে তাকে রুচিশীল করা। ব্যক্তি পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে যে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যাবলী পেয়ে থাকে অনেক সময় তা ইতিবাচক ও কল্যাণকর না-ও হতে পারে। যে সকল সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ইতিবাচক ও কল্যাণকর নয় তা পরিহার করতে সাহায্য করে শিক্ষা। আবার সংস্কৃতির যে সকল দিক সবার জন্য ইতিবাচক, কল্যাণকর ও প্রত্যাশিত যে সকল দিক বা বৈশিষ্ট্যকে আরও উন্নত করতে পারে শিক্ষা।
৫) নৈতিক চরিত্র গঠনমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- অনেক শিক্ষাবিদের মতে, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠন। যেমনটি বলেছেন জার্মান দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জোহান ফ্রেডারিক হার্বার্ট। হার্বার্ট বলেন, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনই হবে শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
৬) জীবনধারণমূলক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য- শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হল পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন। সমাজবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেন্সার শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে বলেছেন- মানুষকে সুখী জীবন যাপন করতে হলে বহুমুখী গুণ বা দক্ষতার অধিকারী হতে হয়। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ সঠিকভাবে জীবনধারণ ও জীবনধারণের সঠিক পদ্ধতি খোঁজ পেতে সক্ষম হয়। শিক্ষা হল জীবনযাপনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি। মানবসমাজে প্রতিনিয়ত যেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তেমনই সমাজ বিকশিতও হচ্ছে। এর ফলে মানবসমাজ নানান বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে এবং ভবিষ্যতেও অনেক বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে। তাই সব কিছুর সাথে ব্যক্তিকে মানিয়ে নিয়ে বা চলমান জীবনধারার উপযোগী করে তোলাও শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
0 Comments: