
দর্শন কথার অর্থ কী? শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্ক
দর্শনের কোনও সুস্পষ্ট সংজ্ঞা এক কথায় প্রদান করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দর্শনের সংজ্ঞা দিয়েছেন বা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মহান দার্শনিকগণ দর্শনের যে সকল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা পর্যালােচনা করলে যে সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, প্রত্যেক দার্শনিকই জগৎ ও জীবনের ব্যাখ্যা, জগতের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক, স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিক কর্তৃক প্রদত্ত দর্শনের প্রামাণ্য সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হল-
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতে, “চিরন্তন এবং বস্তুর মূল প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন করাই দর্শনের লক্ষ্য”।
অ্যারিস্টটলের মতে, “আদি সত্ত্বার স্বরূপ এবং সেই স্বরূপের অঙ্গীভূত যে সব বৈশিষ্ট্য তার অনুসন্ধান করে যে বিজ্ঞান তাই হল দর্শন”।
কানিংহাম বলেন, “মানুষ দার্শনিক হবে কি না, তা কোনাে প্রশ্ন নয়; প্রশ্ন হলা ভালাে এবং মন্দ এই দুই দর্শনের মধ্যে একটিকে নির্বাচন করা”।
শেলিং-এর মতে, “জগৎ ঠিক কি হলে মন একে বুঝতে পারবে এবং মন ঠিক কি হলে জগৎ একে বুঝতে পারবে এটি নির্দিষ্ট করার চেষ্টাই দর্শন”।
আর. জে. হার্স্ট-এর মতে, “জগৎ ও মানব প্রকৃতি সম্পর্কে যেসব নির্দিষ্ট মৌলিক সমস্যা আছে তার যৌক্তিক উত্তর অনুসন্ধানই হচ্ছে দর্শন”।
উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলিকে পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, জীবন ও জগৎকে ঘিরে উদ্ভূত মৌলিক সমস্যাগুলির যৌক্তিক অনুসন্ধান এবং চলার পথে তার যৌক্তিক প্রতিফলন ঘটানোই হল দর্শন।
দর্শন শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ-
দর্শন শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত 'দৃশ্' ধাতু থেকে। যার অর্থ হল দেখা। কিন্তু এখানে দর্শন শব্দটি তত্ত্বদর্শন অর্থাৎ জগৎ ও জীবের স্বরূপ উপলব্ধি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার দর্শন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Philosophy শব্দটি গ্রিক শব্দ 'Philos' এবং 'Sophia' থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। 'Philos' শব্দের অর্থ অনুরাগ বা ভালোবাসা (Loving) এবং 'Sophia' শব্দের অর্থ হল জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (Knowledge/Wisdom)। অর্থাৎ Philosophy শব্দের অর্থ হল জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ বা ভালোবাসা। সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি বা তার সাক্ষাৎকারই দর্শন। ভারতীয় দৃষ্টিতে যার সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়েছে, যার তত্ব সাক্ষাৎকার ঘটেছে, যিনি এই বিশ্বজগৎ ও জীবনের স্বরূপ জেনেছেন তিনিই হলেন প্রকৃত দার্শনিক।
শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্ক-
শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এরা একে অপরের পরিপূরক। দর্শনকে বাদ দিয়ে যেমন শিক্ষা গড়ে উঠতে পারে না তেমনি শিক্ষা ছাড়াও দর্শনের জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষা ও দর্শন একই মুদ্রার দুইটি পিঠ। দার্শনিকের কাজ হল জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সত্যের অনুসন্ধান করা। আর এই জ্ঞান অর্জন করতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। যে কোন শিক্ষাব্যবস্থার ভিত মূলত দার্শনিক চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করেই মজবুত হয়ে ওঠে। শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যা ও তার সমাধান করতে সাহায্য করে দর্শন। শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা, সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা, শিক্ষার নতুন নতুন দিক আবিষ্কার করা, শ্রেণিকক্ষের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন- শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, নির্দেশদান কৌশল, শিক্ষা পরিচালনার উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা ইত্যাদি বিষয়গুলিও দর্শনের সাথে যুক্ত। এমনকি শিক্ষণ-শিখণ পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করা হয় দার্শনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে। শিক্ষা হল ব্যক্তির সুপ্ত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে বাস্তবমুখী করার সামগ্রিক প্রক্রিয়া। আর দর্শনের কাজ হল বাস্তবমুখী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। সুতরাং শিক্ষা এবং দর্শন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। একটিকে বাদ দিলে অপরটির গুরুত্ব থাকে না।
শিক্ষা ও দর্শন যে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সে বিষয়ে বিভিন্ন দার্শনিকগণ তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন-
John Dewe-এর মতে দর্শন হল সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বিত শিক্ষার একটি তত্ব বিশেষ। তিনি মনে করেন যে শিক্ষা হল একটি গবেষণাগার যেখানে দর্শনের তথ্যগুলি যাচাই করা হয়ে থাকে।
John Adams বলেছেন, শিক্ষা হল দর্শনের গভীর অভিব্যক্তি।
দার্শনিক Ross বলেছেন দর্শন ও শিক্ষা হল একই মুদ্রার দুইটি দিক। যার একটি হল ধ্যানের ও অপরটি হল কর্মের দিক।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, দর্শন এবং শিক্ষা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক সত্যগুলির প্রতিষ্ঠা, প্রসার ও স্থায়িত্ব লাভ করেছে শিক্ষার মধ্য দিয়ে। তাই শিক্ষা ছাড়া দর্শনের কোনও ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই, আবার দর্শন ছাড়া শিক্ষাও অস্তিত্বহীন।
শিক্ষা ও দর্শনের সম্পর্কগুলি নিম্নে পর্যালোচনা করা হল-
১) জীবনের গতি নির্ধারণে- মানব জীবনের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করা দর্শন ও শিক্ষার কাজ। শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর সুস্থ সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আর দর্শনের কাজ হল আধুনিক বাস্তবধর্মী শিক্ষার মাধ্যমে জীবনের যথার্থ গতি সৃষ্টি করা যার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ সাধিত হয়।
২) মুক্ত চিন্তার বিকাশ সাধন- দর্শন মানুষের চিন্তার বিকাশ ঘটায়। আর শিক্ষা ব্যক্তির মুক্তচিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করে। কাজেই দর্শন ও শিক্ষা উভয়ই ব্যক্তিকে মানব উন্নয়নে সহায়তা করে। জন ডিউই বলেছেন- "Life is a by product activities and education is born out of those activities". অর্থাৎ, যে সক্রিয়তার মাধ্যমে ব্যক্তি তার জীবনের প্রয়োজন মেটাচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াই তাকে শিক্ষার কাজে সহায়তা করছে।
৩) ব্যক্তি চেতনার উন্মেষ- দর্শন ব্যক্তি চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যার প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ে। মানবীয় চেতনা যেদিকে প্রভাবিত হয় ব্যক্তির শিক্ষাও সেই দিকে ধাবিত হয়। কাজেই ব্যক্তির সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে এবং ব্যক্তি চেতনার প্রয়োগে দর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। (The art of education will never attain complete clearness without philosophy) অর্থাৎ শিক্ষা শিল্প ও দর্শন ছাড়া কখনই সম্পূর্ণতা পেতে পারে না।
৪) শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ- শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। লক্ষ্য ছাড়া শিক্ষা অর্থহীন। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ভর করে চিরাচরিত ও সমসাময়িক জীবন দর্শনের উপর। তাই যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্যেরও পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত হয় দার্শনিক চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে। অভিজ্ঞতা যদি শিক্ষামূলক হয় তবে শিক্ষাক্রমকে অবশ্যই দার্শনিক চিন্তাভাবনা অনুযায়ী হতে হবে।
৫) পাঠক্রম নির্ধারণ- শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের পর কীভাবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো হবে পাঠক্রম হল সেই লক্ষ্য অভিমুখী পথ। লক্ষ্য পূরণের বিষয়বস্তু ও ক্রিয়া-কলাপ নির্দেশ করে এই পাঠক্রম। পাঠক্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে দার্শনিকদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। দর্শন জীবনের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে পাঠক্রমের গতিপ্রকৃতি ও বৈচিত্র্যতা নির্ধারণ করে। শিশুর মধ্যে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতার বিকাশ ঘটানোর দরকার তা নির্ধারণ করে দর্শন। দর্শন হল একটি কাঠামো যার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার অবয়ব গড়ে উঠেছে।
৬) মূল্যবোধের বিকাশ- দর্শন হল জীবনের মৌলিক মূল্যবোধের গবেষণাগার। আর শিক্ষা এই গবেষণাগারের ফলাফলকে বাস্তবায়ন করে জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তোলে। দর্শন শিক্ষাকে গতিশীল করে রাখতে সাহায্য করে। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন- "The unexamined life is not worth living". অর্থাৎ অপরিচিত জীবন যাপন করার কোন মূল্য নেই।তিনি জগতের সমস্ত কিছুকে পরীক্ষা করেছিলেন, সমস্ত কিছুকে অনুসন্ধান করেছিলেন। তার কাছে দর্শন হল জীবনকে পরীক্ষা করা।
৭) শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি নির্ধারণ- শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি। আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করা হয়। দার্শনিকগণ শিক্ষার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই শিক্ষণ পদ্ধতিগুলি কেন এবং কিভাবে প্রয়োগ করা হবে তার প্রাথমিক জ্ঞান দান করে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি প্রণয়ন ও তার ব্যবহার দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।
৮) মূল্যায়ন- শিক্ষাক্ষেত্রে মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিক্ষার লক্ষ্য স্থির করার পর শিক্ষার সঠিক পথে অগ্রগতি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করার জন্য মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। শিক্ষার লক্ষ্য যেহেতু দার্শনিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত সেহেতু সমগ্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে শিক্ষা এবং দর্শন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষা ও দর্শন হল জীবন প্রবাহের দুটি দিক। একটি ব্যবহারিক আর অপরটি হল তাত্ত্বিক। শিক্ষা যেহেতু জীবনকেন্দ্রিক আবার জীবনকে বাদ দিয়ে কোন দর্শন হয় না। তাই ব্যাক্তিজীবনকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ও দর্শনে উভয়েরই উদ্ভব ঘটেছে।
0 Comments: