পাঠক্রমের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য (Concept and characteristics of Curriculum)
INFO Breaking
Live
wb_sunny

Breaking News

পাঠক্রমের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য (Concept and characteristics of Curriculum)

পাঠক্রমের ধারণা ও বৈশিষ্ট্য (Concept and characteristics of Curriculum)

পাঠক্রমের ধারণা: 


    পাঠক্রম শব্দটি ইংরেজি Curriculum শব্দের সমর্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভাষাবিজ্ঞানের মতে মূল ল্যাটিন শব্দ Currere থেকে ইংরেজি Curriculum শব্দের উৎপত্তি। ল্যাটিন Currere শব্দের অর্থ হল দৌড় বা দৌড়ান। তাই ইংরেজি ক্যারিকুলাম শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল দৌড়। কিন্তু পরবর্তীকালে ব্যবহারিক পরিবর্তনের ফলে ক্যারিকুলাম শব্দটির দ্বারা দৌড়ানোর কাজকে না বুঝিয়ে দৌড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পথকে বোঝানো হয়। অর্থাৎ শেষ সীমানায় বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দৌড়ের যে পথ তাই হল ক্যারিকুলাম। শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ হল নির্দিষ্ট পথে (Track) -র উপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে জীবনের তথা শিক্ষার মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। আর শিক্ষকের কাজ হল শিক্ষার্থীকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি নির্দিষ্ট করে দেওয়া। 




    1952 সালে মুদালিয়ার কমিশনের রিপোর্টে পাঠক্রমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-


"শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে, শ্রেণিকক্ষে, গ্রন্থাগারে, পরীক্ষাগারে, কর্মশালায়, খেলার মাঠে এবং শিক্ষকদের সংস্পর্শে এসে যা কিছু শেখে তাই হল পাঠক্রম।"


    মনোবিদ ক্রো এবং ক্রো বলেছেন- "শিক্ষার্থীর ব্যক্তিসত্তার মানসিক, দৈহিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক এবং নৈতিক ইত্যাদি সকল দিকের বিকাশের উদ্দেশ্যে শিক্ষালয়ের অভ্যন্তরে ও বাইরে যে সকল সহায়ক অভিজ্ঞতার সূত্র পরিকল্পিতভাবে রচনা করা হয় তাদের সমন্বয়ই হল পাঠক্রম।"


Traditional concept: প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী পাঠক্রম ছিল শিশুর বা শিক্ষার্থীর মৌলিক চাহিদাগুলি (আহার, বস্ত্র ও বাসস্থান) নিবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কতগুলি কাজের সমবায়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলগুলিই ছিল শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু। যাকে আধুনিক পরিভাষায় পাঠক্রম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।


    শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য যে পাঠক্রমের মাধ্যমে কতকগুলি বিষয়ে পুঁথিগত জ্ঞানদানের ব্যবস্থা করা হয়, তাকে বিষয়কেন্দ্রিক পাঠক্রম বা গতানুগতিক পাঠক্রম বলা হয়। এই জাতীয় পাঠক্রম পুরােপুরিভাবে ভাষামূলক এবং পুথিগত বিদ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা কেবল বই পড়া, শিক্ষক-শিক্ষিকার বক্তৃতা শােনা, লেখা প্রভৃতি কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।


    এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-তে পাঠক্রমের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- 'পাঠক্রম হল যে কোন এক প্রকারের শিক্ষালয়ে শিক্ষার বিশেষ স্তরে অনুসৃত জ্ঞানমূলক বিষয়সমূহের সমবায়'।   



Modern Concept: পরিবর্তনশীল পরিবেশের মধ্যে ব্যক্তির পরিবর্তনশীল চাহিদা গুলির পরিতৃপ্তির মাধ্যমেই তার জীবনের বিভিন্ন দিকের বিকাশ ঘটে আর সেই বিকাশের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করাই হল আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য। এই কারণে সমগ্র শিক্ষা প্রক্রিয়াকে গতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাই আধুনিককালে পাঠক্রমের ধারণাকে যথেষ্ট নমনীয় করা হয়েছে তার পরিসরকে প্রয়োজনমত বিস্তৃত করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। এই বিস্তৃতির দায়িত্ব শিক্ষা পরিচালক বা শিক্ষকের উপর দেওয়া হয়েছে। আধুনিক তাৎপর্যে শিক্ষার্থীগণ শিক্ষালয়ে শিক্ষকের পরিচালনায় যা কিছু শেখে তাই পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত।


বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ (Peyne) বলেছেন-

"শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিসত্তার বিকাশ এবং তার মধ্যে আচরণ পরিবর্তনের জন্য বিদ্যালয়ে যেসব কর্মসূচী নির্বাচন করে এবং সচেতন ভাবে পরিচালনা করে তার সমন্বয়িত রূপই হল পাঠক্রম।"


    আধুনিক শিক্ষার তাত্ত্বিক ধারণা অনুযায়ী পাঠক্রম কেবলমাত্র কতগুলি প্রথাগত পাঠ্য বিষয়ের সমন্বয়ই নয়, শিক্ষালয়ের শ্রেণীকক্ষে, গ্রন্থাগারে, পরীক্ষাগারে, খেলার মাঠে, কর্মশালায় এবং অন্যান্য স্থানে শিক্ষার্থীরা যত প্রকারের অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হয় এবং শিক্ষক শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী যে সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তাদের সকলের সমন্বয়িত একক রূপই হল পাঠক্রম।



    সুতরাং, এককথায় বলা যায় যে, শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের উপযোগী জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, কার্যাবলী, সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত এবং সুসমন্বিত অভিজ্ঞতার সার্থক সমন্বয় হল পাঠক্রম।



পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য:


    পৃথিবীতে একটি জাতি বা দেশ পরিচিত হয় তার জনগণের মধ্য দিয়েই। মানুষ তৈরি করার জন্য যেসব শক্তিশালী উপাদান প্রয়োজন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল শিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। এই যথার্থ শিক্ষা নির্ভর করে দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ উপাদানের ওপর। একটি হল শিক্ষকের গুন আর অন্যটি হল পাঠক্রমের স্বরূপ বা প্রকৃতি।


উপরের সংজ্ঞাগুলি বিশ্লেষণ করলে আধুনিক পাঠক্রমের যে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হল-


১. উদ্দেশ্য নির্ভর- পাঠক্রম হল শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই পাঠক্রম উদ্দেশ্যকেন্দ্রিক। পাঠক্রমের সাহায্যে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। অর্থাৎ, কোন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য পাঠক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়।


২. নির্বাচনধর্মী- জীবন বিকাশের উপযোগী শিক্ষার যে স্তর সেই অনুযায়ী পাঠক্রমের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়। তাই পাঠক্রমটি হল নির্বাচনধর্মী। অনেকগুলি বিষয়ের মধ্যে শিক্ষার্থী তার লক্ষ্য অনুযায়ী বিষয়বস্তু নির্বাচন করবে।


৩. সমষ্টিমূলক- শিক্ষার লক্ষ্য শিশুর সার্বিক বিকাশ ঘটানো। তাই যে কোন পাঠক্রম এমন কতগুলি অভিজ্ঞতার সমবায় গঠিত, সেগুলি সম্পাদনের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।


৪. পরিবর্তনশীল- বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে সমাজের পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকাতেও পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রমেরও পরিবর্তন ঘটছে।


৫. নমনীয়- শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বৈষম্য স্বীকার করে নিয়ে পাঠক্রম নমনীয় হবে।


৬. ব্যক্তিত্বের বিকাশ- পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়তা করে।


৭. অভিজ্ঞতার সমন্বয়- আধুনিক অর্থে পাঠক্রম হল জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের অভিজ্ঞতার সমন্বয়।


৮. কর্মকেন্দ্রিক- পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীর সক্রিয়তাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। কর্মের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে।


৯. মূল্যবোধ সৃষ্টি- পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।


১০. চাহিদা ও সামর্থ্য ভিত্তিক- পাঠক্রম তৈরি করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।


১১. গণতান্ত্রিক মনোভাবের বিকাশ- স্বাধীনতা, সাম্য, সুবিচার, দলগত মনোভাব ইত্যাদি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিকাশে পাঠ্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


১২. বাস্তবভিত্তিক- আধুনিক পাঠক্রম ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থী বাস্তব সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে।


১৩. শ্রেণী ও শ্রেণী বহির্ভূত অভিজ্ঞতা- শিক্ষাবিদগণ মনে করেন, একটি আদর্শ পাঠক্রমে দুটি অংশ থাকবে। যার একটি অংশে থাকবে শ্রেণিকক্ষের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা, ও অপর অংশে থাকবে শ্রেণিকক্ষ বহির্ভূত অভিজ্ঞতা। বাস্তব পাঠক্রমের ধারণা অনুযায়ী পাঠক্রম শ্রেণী অন্তর্ভুক্ত ও শ্রেণী বহির্ভূত অভিজ্ঞতার সমন্বয়।


১৪. আদর্শমূলক- পাঠ্যক্রম রচিত হয় কতগুলি নীতির উপর ভিত্তি করে; শিক্ষার্থীর চাহিদা, সামর্থ্য, প্রবণতা এবং সামাজিক চাহিদার উপর নির্ভর করে। এছাড়া এই পাঠক্রম তৈরি হয় বৈজ্ঞানিক ও মনোবৈজ্ঞানিক যুক্তির উপর ভিত্তি করে।


১৫. মূল্যায়নমূলক- পাঠক্রমের মূল্যায়নের মাধ্যমে জানা যায়, শিক্ষার পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি কতটা সফল হয়েছে। তাই আধুনিক পাঠক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল পাঠক্রমের মূল্যায়ন।


১৬. তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকের উপর গুরুত্ব- আধুনিক পাঠক্রমে শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশের জন্য শিক্ষার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে সেজন্য আধুনিক পাঠক্রমে কর্মভিত্তিক অভিজ্ঞতা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।


    সুতরাং বলা যায় আধুনিক পাঠক্রম হল গতিশীল, বিজ্ঞাননির্ভর, মনোবৈজ্ঞানিক, চাহিদাভিত্তিক ও উদ্দেশ্যমুখি যা শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।



0 Comments: