.jpeg)
ভাষা মানবজাতির অমূল্য এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। প্রতিটি স্বাভাবিক মানুষকে তাঁর জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সবসময়ের জন্য ভাষার ব্যবহার করতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য অঙ্গভঙ্গী, রঙ, রেখা, চিত্র, চিহ্ন, আকৃতি, ধ্বনি, ইঙ্গিত ইত্যাদি বহু উপায় ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু সব উপায়ই ভাষা নয়। আমাদের দেশে সৌজন্যসূচক নমস্কার করার ভঙ্গি ভাব প্রকাশের উপায় হলেও ভাষা নয়। তারুণ্য বোঝানোর জন্য সবুজ রঙ, ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া রঙ এবং শান্তি বা পবিত্রতার প্রতীক স্বরূপ সাদা রঙ পতাকায় ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এই রঙের মাধ্যমে ভাব প্রকাশিত হলেও তা ভাষা নয়। শুধু মানুষ নয় মনুষ্যেতর প্রাণীও ভাব প্রকাশে সক্ষম। রাগ, ভয়, ক্ষুধা, আনন্দ ইত্যাদি স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করে। গৃহপালিত জন্তুদের ডাকের অর্থ আমরা একটু চেষ্টা করলেই বুঝতে পারি। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পাখির নানারকম ডাক ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। তবে ভাব প্রকাশিত হলেও এগুলি কিন্তু ভাষা নয়।
ভাষা বলতে কী বোঝায়?
ভাষা হল মানুষের বাগযন্ত্র নিঃসৃত ধ্বনিবাহিত অর্থসমন্বিত নিয়ম নির্দিষ্ট এক সংকেত যা কোন এক নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদানের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
ভাষার সংজ্ঞা-
মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত, ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে। - (ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়)
ভাষার শর্ত-
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা ভাষার বেশ কিছু শর্ত নির্ণয় করতে পারি। যেমন-
ক) ভাষা হল চিন্তার অর্থপূর্ণ শব্দসমষ্টি।
খ) সংযোগ সাধনের একটি প্রধান ব্যবস্থা হল ভাষা।
গ) ভাষার লিখিত ও মৌখিক দুটি রূপ আছে।
ঘ) ভাষা কোন প্রতীক (Symbol) -এর মাধ্যমে রূপান্তরিত একপ্রকার সংকেত।
ঙ) বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত হয়, তাই ভাষাকে সামাজিক সংস্থাও বলা হয়।
চ) প্রতিটি ভাষার একটি স্বতন্ত্র রূপ ও নাম থাকবে।
ছ) ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলি যে বস্তু বা ভাবের প্রতীক হয় তার সঙ্গে সেই শব্দের কোন কার্য-কারণ সম্পর্ক নেই।
ভাষার মূল উপাদান-
ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ভাষার তিনটি উপাদান রয়েছে-
১) ধ্বনি/ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)- মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত যে ধ্বনি তাকে 'Phone' বলে। আর 'Phonology' বলতে বোঝায় শব্দ গঠনে ধ্বনির ব্যবহার। প্রত্যেক ভাষারই অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মৌলিক এবং স্বতন্ত্র ধ্বনি। এগুলিই হল ভাষার ক্ষুদ্রতম একক। এই ধ্বনি বা এককগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে উচ্চারিত হয় অর্থ ব্যক্ত করে। অর্থসহ ভাষার ক্ষুদ্রতম একককে রূপিম (Morpheme) বলে। যেমন- ফুল, পাখি, জল, গৃহ ইত্যাদি। শিক্ষার্থীর ভাষার বিকাশে রূপিম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু প্রথমে ধ্বনি উচ্চারণ করে, পরে সেটি অর্থযুক্ত শব্দের রূপ পায়। শৈশবে ধ্বনির সঙ্গে অর্থযুক্ত হয় প্রধানত অনুবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
২) বাক্য বিন্যাস/বাক্যতত্ব (Syntax)- এক্ষেত্রে শব্দগুলি বিন্যস্ত হয়ে বাক্যে পরিণত হয় অর্থাৎ বাক্যবিন্যাস হল একপ্রকার ভাষার ব্যাকরণ। এর কাজ হল রূপিম গুলি একত্রিত করে অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করা। 'আমি বিদ্যালয়ে যাচ্ছি' -এখানে আমি, বিদ্যালয়ে, যাচ্ছি- এগুলি রূপিম এবং আমি বিদ্যালয়ে যাচ্ছি একটি সম্পূর্ণ বাক্য। শিশুরা ধীরে ধীরে এগুলি অনুকরণের মাধ্যমে শিখতে থাকে।
৩) শব্দের অর্থ/শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)- ভাষার মৌলিক উপাদানগুলি আয়ত্তের সঙ্গে সঙ্গে শিশু ভাষার অসীম ক্ষমতা উপলব্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৪-৫ বছরের মধ্যেই শিশু ধ্বনিকে সংযুক্ত করে বাক্য গঠন করার উদ্দেশ্যে শব্দগুলি সংযুক্ত করার নিয়মাবলী শিখে যায়। এছাড়া কথোপকথনের জন্য শব্দের সংযুক্তির নিয়মাবলী আয়ত্ত করার ফলে শিশু অপরিচিত শব্দের অর্থ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। একই Fast maping বা দ্রুত মানচিত্রকরণ বলে। এই কৌশল শিশুকে শব্দার্থ অনুমান করার ক্ষেত্র তৈরী করে দেয়, যার ফলে শিশুর শব্দভাণ্ডার দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
ভাষার বৈশিষ্ট্যসমূহঃ-
অ) যে ধ্বনি কেবলমাত্র মানুষের বাগযন্ত্র থেকে নিঃসৃত হয় তা-ই ভাষা। অর্থাৎ ভাষা হল বাগযান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
আ) ভাষা হল প্রতীক। কারণ, ধ্বনি যদি কোন ভাষার বাহন বা প্রতীক না হয়, তাহলে তাকে ভাষা বলা যায় না।
ই) ভাষার বহিরঙ্গ (ধ্বনি) ও অন্তরঙ্গ (অর্থ) দুটি রূপ বর্তমান।
ঈ) ভাষার মধ্যে ব্যবহৃত কোন্ ধ্বনিটি কোন্ ভাবের প্রতীক হবে সে সম্পর্কে কোন কার্যকারণগত সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই।
উ) মানুষ ইচ্ছানুযায়ী পছন্দমত শব্দকে ভাষায় ব্যবহার করতে পারে।
ঊ) বিধিবদ্ধ বিন্যাসক্রম হল ভাষার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
ঋ) ভাষা কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ও স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত।
0 Comments: