.jpeg)
পৃথিবীর প্রধান ভাষাবংশগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ (A brief description of the world's major language families)
ভাষাতত্ত্ববিদদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে বসবাসকারী মোট জনমানব পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বা যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রায় চার হাজার ভাষার ব্যবহার করে থাকেন। তবে এগুলি সবই প্রধান ভাষা নয়। কারণ, সভ্যতার জন্মস্থান যেমন পৃথিবীর নির্দিষ্ট কোন এক স্থান থেকে গড়ে ওঠে নি, তেমনি ভাষাও নানা স্থানে নানা ভাবে প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছে। তারপর কালের বিবর্তনে সেগুলি রূপান্তরিত হয়ে এক একটি স্বতন্ত্র ভাষায় পরিবর্তিত হয়েছে। এই স্বতন্ত্র ভাষাগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যতা থাকলেও কিছু মৌলিক সাদৃশ্য দেখা যায়। বিশেষ করে একই উৎস থেকে জাত ভাষাগুলির মূল শব্দভাণ্ডারে কখনও পারিবারিক ও সামাজিক শব্দে, কখনও গৃহপালিত পশুর নামে, আবার কখনও দৈনন্দিন কর্মব্যবহৃত শব্দে সাদৃশ্য চোখে পড়ে। এই সাদৃশ্যের ভিত্তিতেই বলা যেতে পারে যে, ভাষাগুলি একই ভাষাগত উৎস বা ভাষাবংশ থেকে জাত। পৃথিবীতে ব্যবহৃত প্রধান/অপ্রধান এই চার হাজার ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট কয়েকটি ভাষাবংশ বা ভাষাপরিবারে ভাগ করেছেন। এগুলির বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হল-
১) ইন্দো-ইউরোপীয় : পৃথিবীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভাষা পরিবারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার। কারণ, এই ভাষা পরিবার থেকে জাত অধিকাংশ ভাষাগুলিই বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক ভাষা। এই ভাষাবংশের জন্মলগ্ন আনুমানিক ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলি এশিয়া থেকে আইসল্যান্ড পর্যন্ত স্থানে বিস্তৃত।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের দুটি প্রধান ভাগ হল- i) কেন্তুম বর্গ ও ii) সতম্ বর্গ। কেন্তুম বর্গের ভাষাগুচ্ছের মধ্যে রয়েছে জার্মানিক, ইতালিক কেলতিক ও গ্রিক ভাষাসমূহ। আর সতম্ বর্গের মধ্যে রয়েছে বালতো-স্লাভিক, আর্মেনিয়, আলবেনিয়া ও ইন্দো-ইরানীয়। এই ভাষা পরিবারের সমৃদ্ধ প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত থেকেই পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ সংহিতা রচিত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমাদের ব্যবহৃত জনপ্রিয় বাংলা ভাষাও এই ভাষা পরিবার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।
২) সেমিয়-হামিয় : পশ্চিম এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষা পরিবার সেমিয়-হামিয়। এর দুটি শাখা সেমিয় ও হামিয়। সেমিয় ভাষাগুচ্ছের প্রধান প্রধান ভাষা হল 'হিব্রু' ও 'আরবি'। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হয়েছিল হিব্রু ভাষাতে। আর আরবি ভাষা মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। হামিয় ভাষাগুচ্ছের প্রধান ভাষা 'মিশরি'। বর্তমানে এটাকে লুপ্ত ভাষা বলা চলে। অনেক ভাষাতত্ত্ববিদ সেমিয়-হামিয় ভাষা পরিবারটিকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের পর এই ভাষা বংশের কথাই সর্বাধিক আলোচিত। এই ভাষাগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষা পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার উত্তর অংশের নানা স্থানে প্রচলিত থাকায় এর নতুন নামকরণ করা হয়েছে 'এফ্রো-এশিয়' ভাষা।
৩) বান্টু : দক্ষিণ আফ্রিকার দুটি প্রধান ভাষা হল জুলু ও বান্টু। আফ্রিকার যেখানে সেমিয়-হামিয় ভাষা প্রচলিত নয়, সেখানে বান্টু ভাষাই প্রচলিত। এই ভাষার গোষ্ঠীভুক্ত উপভাষার সংখ্যা অনেক। অনেকে মনে করেন বান্টু ভাষাগুচ্ছের অন্তর্গত ভাষা সোয়াহিলি, কাফির, লুবা ইত্যাদি।
৪) ফিন্নো-উগ্রিয় : ইউরোপে আরও একটি ভাষা পরিবার প্রচলিত। এই পরিবারটির নাম ফিন্নো-উগ্রিয়। এর অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলি হল- ফিনল্যান্ডের ভাষা ল্যাপ, ফিন্নিয়, এস্তোনিয়ার ভাষা এস্থোনিয়ান ও হাঙ্গেরির ভাষা হাঙ্গেরিয় ইত্যাদি। এই ভাষাগুলি উরাল ভাষা নামেও পরিচিত।
৫) তুর্ক-মঙ্গল-মাঞ্চু : সমগ্র মধ্য এশিয়ায় তুর্ক-মঙ্গল-মাঞ্চু ভাষা পরিবার বিস্তৃত। এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত তুর্ক ভাষা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই ভাষা তুরস্কের জগতাই, মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্থান, উজবেকিস্থান অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। মঙ্গোলিয়ার কিছু অংশে প্রচলিত মঙ্গল ভাষা ও মাঞ্চুরিয়ায় প্রচলিত মাঞ্চু ভাষা এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষা পরিবারকে একসঙ্গে উরাল-আলতাই ভাষাগোষ্ঠীও বলা হয়।
৬) দ্রাবিড় : দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা পরিবার হল দ্রাবিড়। এর মধ্যে প্রধান চারটি অনার্য ভাষা তামিল, তেলেগু, কানাড়ি ও মালোয়ালম। এই পরিবারের ভাষাগুলি টুলু, টুডু ও কুড্গু সিংহল ও উত্তরাপথের দু-এক স্থানে দ্রাবিড় ভাষাগুচ্ছের ভাষায় কথা বলার প্রচলন রয়েছে। বেলুচিস্থানের পার্বত্য অঞ্চলের 'ব্রাহুই' ভাষাও এই পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়া ভারতের অন্যান্য ভাষাতেও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে।
৭) অস্ট্রিক : দক্ষিণ এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে পলিনেশিয়া, মেলানেশিয়া পর্যন্ত অস্ট্রিক পরিবারের ভাষাগুলি প্রচলিত। এই ভাষাবংশের দুটি শাখা। যেমন- 'অস্টো-এশিয়াটিক' ও 'অস্টোনেসিয়া'। অস্টো-এশিয়াটিকের আবার দুটি উপশাখা- মোন্ খমের্ ও কোল মুন্ডা। অষ্ট অস্টো-এশিয়াটিক ভাষাগুলির একটি প্রধান ভাষা 'খাসিয়া'। এটি মেঘালয় রাজ্যের প্রধান ভাষা। আর মুন্ডিক শাখার ভাষা হল সাঁওতাল, মুন্ডা ও হো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অস্টোনেসিয়ান ভাষাগুলিও দুই শাখায় বিভক্ত। যথা মেলানেশিয়ান ও মালয়োপলিনেশিয়ান। মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে মেলানেশিয়ান ভাষাগুচ্ছের ভাষাগুলি অবস্থিত। আর মালয়োপলিনেশিয়ান ভাষাগুলি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে অবস্থিত। নিউজিল্যান্ডের আদিম উপজাতি মাওরিদের ভাষাও অস্টিক ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
৮) ভোট-চিনিয় : ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের মতোই ভোটচিনিয় ভাষাপরিবারও বিখ্যাত। ভাষাবিজ্ঞানে এই পরিবারটিকে বলা হয় সিয়ামিজ-চাইনিজ ভাষা। এই পরিবারের তিনটি শাখার ভাষাগুলি হল- চীনের চিনিয় ভাষা, শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ডের সিয়ামিজ ভাষা ও ভারতে প্রচলিত তিব্বতি-বর্মী গোষ্ঠীর বর্মী ভাষা। তবে প্রথম শাখার চীনা ভাষাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ভাষা। হিমালয়ের পাদদেশে প্রচলিত লেপচা, গারো, নাগা, কুকি প্রভৃতি ভাষা ভোট-চিনিয় শাখার অন্তর্ভুক্ত।
৯) ককেশিয় : ককেশাস পর্বতমালার বিভিন্ন জায়গায় এই বংশের ভাষা প্রচলিত। এই পরিবারের ভাষাগুলি ছোট ছোট ভাষায় বিভক্ত। অনেকে বলেন কৃষ্ণসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত। এই পরিবারের প্রধান ভাষার নাম 'জর্জিয়ান'।
১০) এস্কিমো : চির তুষারাবৃত উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর কানাডা, গ্রীনল্যান্ড, উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও উত্তর রাশিয়ার মানুষদের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলি 'এস্কিমো' ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। গ্রিনল্যান্ড থেকে আলেউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত ভূভাগে এস্কিমো বংশের ভাষাগুলির বিচরণ ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়।
১১) আমেরিকার আদিম ভাষা : উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের ভাষাসমূহ এই ভাষাপরিবারের অন্তর্ভুক্ত। জানা গেছে আগে আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের একটি নির্দিষ্ট ভাষা ছিল। কিন্তু তাদের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষা লুপ্ত হয়েছে। তবে এই আদিম অধিবাসীদের মধ্যে এখনো যারা রয়েছে তাদের মধ্যে আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের ভাষাগুলি এই ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলিকে এককথায় বলা হয় আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ভাষা পরিবার। এই ভাষাপরিবারের সদস্যগুচ্ছকে মোট আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে আলগঙ্কিয়ান, ইরোকোরিয়ান, পিমান, নাহুয়াটলান বিখ্যাত।
বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত মানুষজন যে পরিমান ভাষা ব্যবহার করে তা কখনই নির্দিষ্ট কয়েকটি ভাষা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তবে সময়ের স্রোতে কখনো অনেক নতুন ভাষার সৃষ্টি হয় আবার কখনো অব্যবহারের ফলে অনেক ভাষাকে বিলীন হতেও দেখা যায়। তাই ভাষাবিজ্ঞানীদের পক্ষে একদম নিখুঁত হিসাব রাখা সম্ভব হয় না। এখানে আলোচিত ভাষাপরিবারগুলি ছাড়াও আরও অনেক ভাষা পরিবার রয়েছে, কিন্তু সেগুলি অনেক প্রাচীন এবং ব্যবহারযোগ্যতা হ্রাসের কারণে বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেনি।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments: