
প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব (Classical Conditioning theory of Ivan Pavlov)
প্রাচীন অনুবর্তন বা আপাত অনুবর্তন (Classical Conditioning)
যে অনুবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়াকে তার স্বাভাবিক উদ্দীপকের পরিবর্তে অন্য উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাকে প্রাচীন অনুবর্তন বলে। এক্ষেত্রে শক্তিদায়ক উদ্দীপকের কোন ভূমিকা থাকে না।
প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব (Classical Conditioning theory of Ivan Pavlov)
প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন অভিজ্ঞ সোভিয়েত রাশিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ্, স্নায়ুবিশারদ ও মনোবিজ্ঞানী আইভান পেট্রভিচ প্যাভলভ (1849-1936)। তিনি প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তার মধ্যে কুকুরের লালাক্ষরণ পরীক্ষাটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্যাভলভের মতে প্রাণী তার পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যিক উদ্দীপনা সংগ্রহ করে এবং বাইরের জগৎ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাঁর মতে প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যে যখন কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার জন্য নির্দিষ্ট কিছু উদ্দীপক থাকে এবং যে কোন অবস্থাতেই উদ্দীপকগুলি একই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্যাভলভ এই উদ্দীপকগুলিকে স্বাভাবিক উদ্দীপক এবং প্রতিক্রিয়াগুলিকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন স্বাভাবিক উদ্দীপক এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সংযোগ পূর্ব নির্ধারিত। এর জন্য কোন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আবার যদি কোন স্বাভাবিক উদ্দীপকের সঙ্গে কৃত্রিম উদ্দীপককে বারবার উপস্থাপন করা হয় তবে স্বাভাবিক উদ্দীপকটি কৃত্রিম উদ্দীপকের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং স্বাভাবিক উদ্দীপক যে প্রতিক্রিয়া ঘটাবে কৃত্রিম উদ্দীপকও সেই একই প্রতিক্রিয়া ঘটাবে।
প্যাভলভ তার পরীক্ষার জন্য একটি ক্ষুধার্ত কুকুর নিলেন। এরপর কুকুরটির সামনে কিছু খাবার দেওয়া হল। দেখা গেল খাবার দেখার সাথে সাথে কুকুরটির লালাক্ষরণ হচ্ছে। লালাক্ষরণের কারণ চোখের সামনে খাদ্যবস্তু দেখা। এটি হল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। প্যাভলভ কুকুরটির লালাক্ষরণের পরিমাপেরও ব্যবস্থা করছিলেন। এরপর প্রতিদিন পরীক্ষামূলকভাবে কুকুরটির সামনে খাবার দেওয়ার আগে খাওয়ার সম্পর্কে কুকুরটিকে সচেতন করার জন্য একটি ঘন্টার ধ্বনি শোনানো হয়। ঘন্টার ধ্বনি শেষ হওয়ার আগেই কুকুরটির সামনে খাদ্যবস্তু দেওয়া হয়। কিছুদিন এইভাবে পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করার পর দেখা গেল কুকুরটির ঘন্টার ধ্বনি শোনা মাত্রই লালাক্ষরণ শুরু হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ঘণ্টার শব্দের সঙ্গে লালাক্ষরণের কোন সম্পর্ক নেই। ঘন্টাধ্বনি উদ্দীপকটির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল সজাগ ভাব। তাই প্রথম প্রথম ঘন্টাধ্বনি শোনা মাত্র কুকুরটির মধ্যে সজাগ ভাব দেখা গিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষাটি বার বার পুনরাবৃত্তি করার ফলে ঘন্টাধ্বনি উদ্দীপকের সঙ্গে লালাক্ষরণ যুক্ত হল। এক্ষেত্রে ঘন্টাধ্বনি উদ্দীপক হিসেবে লালাক্ষরণের প্রতিক্রিয়া ঘটাল। খাদ্যবস্তু যখন লালাক্ষরণ ঘটায় তখন তা হল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু যখন ঘন্টাধ্বনি লালাক্ষরণ ঘটায় তখন লালাক্ষরণ হল অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া এবং ঘন্টাধ্বনি হল অনুবর্তিত উদ্দীপক। প্যাভলভ এর নাম দেন অনুবর্তিত আবর্তক্রিয়া। বর্তমানে যাকে অনুবর্তিত প্রতিক্রিয়া বলা হয়।
প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য-
1. Reward and Punishment: পুরস্কার এবং শাস্তির তত্ত্বটি অনুবর্ত ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। শিশু যখন কোন ভাল কাজ করে তখন সে তার কৃতিত্বের জন্য পুরস্কার পায় ফলে সে আরও ভালো হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়। আবার অপকর্মের জন্য যখন সে শাস্তি পায় তখন আর খারাপ কাজের পুনরাবৃত্তি করে না।
2. Remove Superstitions: কিছু কুসংস্কার যেমন, হাঁচি দেওয়া, বিড়ালের পথ অতিক্রম করা ইত্যাদি দূর করা যায় এই তত্ত্বের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে শিক্ষক এই তত্ত্ব ব্যবহারের দ্বারা শিশুদের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে তুলবেন এবং বাস্তব জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই ধরনের কুসংস্কারের যে কোন স্থান নেই তা বুঝিয়ে দেবেন। ফলে সমাজকে ধীরে ধীরে কুসংস্কারমুক্ত করা যাবে।
3. Attitudes development: এই তত্ত্বটি শিশুর নেতিবাচক মনোভাব দূর করে ইতিবাচক মনোভাবকে উন্নীত করতে সাহায্য করে। এছাড়া শিশুকে ইতিবাচক আচরণ ও মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিশুর সু-অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শিশুদের সামনে নিজেকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করবেন।
4. Helpfull in Adjustment: এটি শিশুকে বিদ্যালয় পরিবেশ থেকে শুরু করে শ্রেণীকক্ষের পরিস্থিতি সবকিছু মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যা পরবর্তীতে তাদের বাস্তব জীবনে সংগতিবিধানে সাহায্য করে। এছাড়া এই তত্ত্ব জীবনের কঠিন ও অদ্ভুত পরিস্থিতিতে সমাধানের পথ তৈরি করতে সক্ষম করে তোলে।
5. Arouses Emotions: অনুবর্তন প্রক্রিয়া শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়, ভালোবাসা এবং ঈর্ষার বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করে। কোন শিক্ষক যদি শিশুকে অতিরিক্ত ভয় দেখান, বকাবকি করেন অথবা সহপাঠীদের মধ্যে তাকে নিয়ে হাঁসি ঠাট্টা করেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিশু সেই শিক্ষকের প্রতি ভয় বা ঈর্ষা প্রদর্শন করবে। আবার যদি কোন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রতি স্নেহ, ভালবাসা উদারতা ও নিরপেক্ষ আচরণ করেন তাহলে তার বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা সেই শিক্ষকের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করবে।
6. Facillitates language learning: শিক্ষক অনুবর্তন প্রক্রিয়াটি শ্রেণীকক্ষে ভাষা শেখানোর জন্য ব্যবহার করতে পারেন। ভাষা প্রশিক্ষণে বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষায় কন্ডিশনিং অনেক বেশি কার্যকর। ভাষার সঠিক ব্যবহার শিশুকে সেই নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহারে সক্ষম করে তোলে। সংস্কৃত ছাড়াও ইংরেজি ও গণিতের মত বিষয়গুলি শেখানোর জন্যও এই অনুবর্তন তত্ত্ব বিশেষ উপযোগী।
7. Facillitates creativity: শ্রেণীকক্ষে দৃশ্য-শ্রব্য উপকরণের ব্যবহার অনুবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সার্থক করে তোলা যেতে পারে। যেমন, শিশুদের 'বাঘ' শব্দ শেখানোর সময় বাঘের একটি ছবি ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে বা দেওয়ালে টাঙিয়ে দিলে শিশুরা সেটি দেখে বাঘ শব্দ উচ্চারণ করবে। এরপর বাঘের ছবিটি মুছে/সরিয়ে দিলেও শিশুরা অনায়াসেই লেখাটি দেখে 'বাঘ' শব্দটির পুনরাবৃত্তি করতে পারবে।
8. Useful in Mental Hospital: প্রেম, স্নেহ এবং ভালো চিকিৎসার কারণে মানসিক বিকারগ্রস্ত বা অস্থির শিশুদের মন থেকে অনেক জটিলতা এবং ভয় দূর করা যায়। তাই তাদের সুস্থ করতে অনুবর্ত প্রক্রিয়া সাহায্য করে।
থর্নডাইকের তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।
0 Comments: