
ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন প্রখ্যাত প্রতিভাবান বিপ্লবী, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্কস (1818-1883) তার বৈপ্লবিক মতাদর্শ সমাজের সকল দিকগুলিকে আলোকিত করেছে। কার্ল মার্কস ও তার বন্ধু ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের আর্থসামাজিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন যা মার্কসীয় দর্শন নামে পরিচিত। অর্থাৎ তাদের মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্বই হল মার্কসবাদ। এঙ্গেলস সর্বপ্রথম মার্কসবাদ শব্দটির ব্যবহার শুরু করেছিলেন। মার্কসবাদ হল একটি সামগ্রিক চিন্তাধারা ও একটি সঠিক সমাজদর্শন।
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলির মালিক শ্রেণী তথা বুর্জোয়া শ্রেণীর ক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাদের দেশের শ্রমিকরাই শোষিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত ছিল। কার্ল মার্কসের মতে সমাজের এই নানা শ্রেণীর বৈষম্যের কারণ হল উৎপাদন ব্যবস্থার বৈচিত্র্য। একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হচ্ছে উৎপাদনের উপর সামাজিক মালিকানা। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত মুনাফা তৈরি নয়, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল সদস্যদের বৈষয়িক ও আত্মিক সন্তুষ্টিকরন। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে উৎপাদন হয় ব্যবহারের জন্য।
এমিল বার্নস- এর মতে "মার্কসবাদ হল আমাদের এই জগৎ এবং তারই অংশ মানবসমাজ সম্পর্কে সাধারণ তত্ত্ব"।
আবার লেনিনের কথায়- "Marxism is the system of the views and teaching of Marx". অর্থাৎ, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গী-ই হল মার্কসবাদ।
মার্কসবাদের প্রবক্তাগণ- মার্কসবাদী দার্শনিকগণ হলেন কাল মার্কস, এঙ্গেলস, স্তালিন, লেনিন, হেগেল, গ্রামসি, মাও-জে-দং প্রমুখ।
মার্কসবাদের মূল নীতি- মার্কসবাদী দর্শনের মূল নীতিগুলি নিম্নে আলোচিত হল-
১) দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ- মার্কসবাদের মূল বক্তব্য হল আমাদের এই জগৎ নিছকই এক বস্তুজগৎ। মন বা আত্মা বলে কিছুই নেই। বস্তুজগতই চরম বাস্তব। এই বস্তুজগতের প্রত্যেকটি উপাদান অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মানুষ তার সংবেদন, প্রত্যক্ষণ, কল্পনা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন বিষয়গুলির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।
২) পরস্পর বিরোধী উপাদান- বস্তুজগৎ পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন বাইরের কোন শক্তির প্রভাবে ঘটে না। পরিবর্তনের বীজ বস্তুর মধ্যেই থাকে। প্রত্যেকটি বস্তুর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক এই পরস্পর বিরোধী উপাদান থাকে।
৩) উৎপাদন প্রক্রিয়া- উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচল রাখার জন্য প্রয়োজন কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, নির্দিষ্ট জায়গা ও বিভিন্ন প্রকার উপকরণের। মালিক শ্রেণীর মানুষদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং শ্রমিকদের শ্রমের ভিত্তিতে এই উপকরণগুলিকে যথাযথ ব্যবহার করে মূলত উৎপাদন সম্ভব হয়ে থাকে।
৪) শ্রেণী সংগ্রাম- উৎপাদন এবং উপকরণের মধ্যে সম্পর্ক প্রধানত মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে স্থাপিত হয়। মালিকরা শ্রমিকদের বেশি পরিশ্রম করতে বাধ্য করে এবং বেশি মুনাফা লাভ করে। আর শ্রমিকদের মুনাফা থেকে বঞ্চিত করে। ফলে পরস্পরবিরোধী একটি সম্পর্কের উদ্ভব হয়। এই পরস্পরবিরোধী সংঘর্ষকেই শ্রেণী সংগ্রাম বলে।
৫) বিপ্লব ও শ্রেণীহীন সমাজ- সমাজের কোন কিছুই স্থায়ী নয়। তাই শোষক ও শোষিত সামাজিক ব্যবস্থাও বেশি দিন চলতে পারে না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন। বিপ্লবের ফলে শ্রেণী সংগ্রামের অবসান ঘটবে এবং এক শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টি হবে। শ্রেণীহীন সমাজে বিত্তবান এবং বিত্তহীন বলে কোন শ্রেণীবিভাগ থাকবে না।
৬) মানুষ ও সমাজের সম্পর্ক- প্রতিটি ব্যক্তিই সমাজের সম্পদ। সমাজের বুকে সকলেই নিরাপদে বসবাস করবে। সামাজিক সুযোগ-সুবিধা সবার জন্য। শুধুমাত্র কয়েকটি গোষ্ঠীর মধ্যে তা আবদ্ধ থাকবে না। মানুষের মধ্যে থাকবে শ্রেণী চেতনা। জীবনের প্রধান লক্ষ্য হবে শ্রেণীহীন সমাজ সৃষ্টি করা।
শিক্ষার লক্ষ্য ও মার্কসবাদ-
i) মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমাজে উচ্চ-নীচ শ্রেণীভেদ থাকবে না। এই সমাজের আদর্শ হবে সাম্য ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। গোষ্টীস্বার্থে পরিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে গেলে বিপ্লবের প্রয়োজন। এই বিপ্লব করার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করাই হবে শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
ii) সকল প্রকার কাজই সম্মানজনক। সমাজের সবরকম কাজে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা এবং শ্রমিক মানে সমাজের বন্ধু এই বোধ জাগ্রত করাই হবে শিক্ষার লক্ষ্য।
iii) সমাজের সমৃদ্ধি নির্ভর করে উৎপাদনের উপর তাই শিক্ষার লক্ষ্য শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহই নয়, প্রত্যেকটি ব্যক্তি যাতে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের দক্ষতা ও সামর্থ্য অর্জন করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
iv) শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সাধারণ বিদ্যালয় থাকবে, কোন বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্য পৃথক কোন বিদ্যালয় থাকবে না।
শিক্ষার পাঠক্রম ও মার্কসবাদ-
1. মার্কসবাদী দর্শন পাঠ শিক্ষার সর্বস্তরের জন্য আবশ্যিক। মার্কসবাদীরা মনে করতেন এই দর্শন পাঠের ফলে শ্রেণীগত বিভাজন, ধন-সম্পদের অসম বন্টন, শ্রমজীবীদের শোষণ ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা সচেতন হবে।
2. সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য কারিগরী ও প্রযুক্তিবিদ্যার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাই উচ্চমানের বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান আহরণের জন্য পাঠক্রমের মধ্যে অঙ্কন, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
3. প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে বিদেশী ভাষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
4. সমাজের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি যেমন বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলিও পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে। এছাড়াও এই পাঠক্রমে কনজিউমের ইতিহাস পাঠ আবশ্যিক করা হয়েছে।
5. সহপাঠক্রমিক বিষয়গুলির উপরও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খেলাধুলা, শারীরশিক্ষা, সঙ্গীত, অঙ্কন প্রভৃতি বিষয়গুলিকেও পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষণ পদ্ধতি ও মার্কসবাদ-
১) শিক্ষার তাত্ত্বিক বিষয়ের উপর গুরুত্ব না দিয়ে ব্যবহারই জ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
২) শিক্ষা শুধুমাত্র বিদ্যালয়ের চার দেওয়ালের মধ্যে জ্ঞান আহরণেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, শিক্ষার্থীরা কাজের মধ্যে দিয়ে শিখবে।
৩) শিক্ষার্থীদের কর্ম অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষক তাদের কৃষিক্ষেত্রে, কারখানায় নিয়ে গিয়ে হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে সাহায্য করবেন।
৪) শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব দূর করে সহযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি করা মার্কসীয় শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৫) শিক্ষার্থীদের যৌথ বা সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য শিক্ষক তাদের উৎসাহিত করবেন।
শৃঙ্খলা- মার্কসবাদী দর্শনে গণতান্ত্রিক বোধ বিকাশের মাধ্যমে শৃঙ্খলা গঠনের কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষকের ভূমিকা- শিক্ষক এখানে শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ রচনা করবেন। এছাড়া শিক্ষকের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সাহায্য করা।
বিদ্যালয়- এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানলাভের পথকে প্রশস্ত করা।
শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে মার্কসবাদী দর্শনের সুপারিশ-
i) শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে কোনরকম বৈষম্য থাকবে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষায় সমান অধিকার থাকবে। শিক্ষার্থীকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
ii) শিক্ষা হবে সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক।
iii) বিদ্যালয়গুলির মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। সকলে যাতে একইরকম শিক্ষার সুযোগ পায় তার জন্য বিদ্যালয়গুলিতে একই রকম পাঠক্রম চালু করতে হবে।
iv) শিক্ষা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তাই শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর বর্তাবে।
v) বিদ্যালয়গুলিতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভূমিকা থাকবে না।
vi) শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাজে অযথা হস্তক্ষেপ করবেন না।
সীমাবদ্ধতা-
মার্কসবাদী দর্শনের বেশ কিছু সমস্যা চোখে পড়ে। যেমন-
i. এই দর্শনে মন ও চেতনাকে গৌণ করে দেখা হয়েছে।
ii. আধ্যাত্ম্যবাদকে এখানে অস্বীকার করা হয়েছে।
iii. এই দর্শন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হওয়ায় এখানে আঞ্চলিক সমস্যা গুরুত্ব পায় না।
iv. এই দর্শন শ্রেণী বৈষম্য ও শ্রেণী সংগ্রামের সাথে যুক্ত।
শিক্ষায় মার্কসবাদের অবদান- মার্কসীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের সমান সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারী পুরুষের শিক্ষার মধ্যে কোন বৈষম্য করা হয়নি। শিক্ষাকে এখানে উৎপাদনমুখী করার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ সৃষ্টি, বঞ্চনা ও শোষণ সম্পর্কে ব্যক্তিকে সজাগ করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি মানুষ যে সমাজেরই একটি অংশ এবং সমাজের প্রতি যে তাদের দায়িত্ব আছে সে সম্পর্কেও তাদের অবগত করা হয়েছে।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় মার্কসবাদকে গ্রহণ করলে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পাঠক্রম ও শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।
0 Comments: