
দার্শনিক মতবাদগুলির মধ্যে ভাববাদ/আদর্শবাদ/আধ্যাত্মবাদ হল প্রাচীনতম দার্শনিক মতবাদ। আদর্শবাদ বা ভাববাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Idealism. ইংরেজি Idea শব্দ থেকে Idealism কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। ভাববাদী দার্শনিকরা মানুষ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক ভাবমূলক সত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে ভাবজগৎ বা আধ্যাত্মিক জগতের অধীশ্বর হলেন ঈশ্বর। আর মানবসত্তার লক্ষ্য হল এই ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারা। ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেমন চিরন্তন সত্য তেমনি জীবনের মূল্যবোধগুলিও চিরন্তন সত্য। ভাববাদী দার্শনিকরা মনে করেন মানুষ একটা আধ্যাত্মিক সত্তা নিয়ে জন্মায়। আর শিক্ষার মধ্য দিয়েই তার প্রকৃত আত্মোপলব্ধি ঘটে।
প্রতিষ্ঠাতা ও সমর্থক-
আদর্শবাদ বা ভাববাদের প্রতিষ্ঠাতা হলেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। এছাড়া ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, শঙ্করাচার্য এবং পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস, ফ্রয়েবেল, কান্ট, হেগেল, গ্রীন, ফিটকে, বার্কলে, স্পিনোজা প্রমুখ আদর্শবাদ বা ভাববাদের সমর্থক ছিলেন।
আদর্শবাদ বা ভাববাদের মূল নীতি-
ক) এই মহাবিশ্ব ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট।
খ) আধ্যাত্মিক জগৎ বস্তুজগতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
গ) মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।
ঘ) মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল আত্ম উপলব্ধি।
ঙ) আত্ম উপলব্ধির জন্য সত্য, ধার্মিকতা ও সৌন্দর্য অপরিহার্য।
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও শিক্ষার লক্ষ্য-
ক) প্রাকৃতিক উপায়ে আত্মবিকাশ
খ) সামাজিক আত্মবিকাশ
গ) বৌদ্ধিক আত্মবিকাশ
ঘ) ধর্মীয় বিকাশ
ঙ) নৈতিক বিকাশ
চ) সাংস্কৃতিক বিকাশ
ছ) সৃজনশীল উন্নয়ন
জ) সার্বজনীন শিক্ষা
ঝ) সংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সম্প্রচার
ঞ) সত্য, ধার্মিকতা ও সৌন্দর্যের উপলব্ধি।
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও শিক্ষার পাঠক্রম-
আদর্শবাদী/ভাববাদীদের মতে ব্যক্তিসত্ত্বার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে-
১) বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য- সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল।
২) ধর্মীয় ও নৈতিক বিকাশের জন্য- ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র।
৩) মানসিক উন্নতি ও সুস্বাস্থ্য গঠনের জন্য- শারীরশিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ব্যায়াম ইত্যাদি।
৪) নান্দনিক বোধ উন্মেষের জন্য- চারুকলা, কবিতা, সঙ্গীত, অঙ্কন ইত্যাদি।
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও শিক্ষণ পদ্ধতি-
আদর্শবাদী/ভাববাদীরা শিক্ষাদানের কোন নির্দিষ্ট বা সংজ্ঞায়িত পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। তারা নিজেদেরকেই পদ্ধতির স্রষ্টা মনে করেন। তাই তারা কোন বিশেষ পদ্ধতি স্বীকার করতে নারাজ। আদর্শবাদী/ভাববাদীরা শিক্ষার জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি নির্ধারণ করেছেন-
✓ নির্দেশনা পদ্ধতি (Instruction Method)- হার্বার্ট
✓ সংরক্ষণ পদ্ধতি (Conservation Method)-প্লেটো
✓ যৌক্তিক পদ্ধতি (Logic Method)-হেগেল
✓ অনুশীলন ও পুনরাবৃত্তি পদ্ধতি (Practice and Repetition Method)-পেস্তালজি
✓ খেলার উপায় (Play way Method)-ফ্রয়েবেল
✓ আরোহী-অবরোহী পদ্ধতি (Inductive-deductive Method)-অ্যারিস্ট্রটল।
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও শৃঙ্খলা-
ক) আদর্শবাদীরা অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বিশ্বাস করে।
খ) তাদের মতে শিশুর স্বাধীনতা সীমিত করা উচিৎ।
গ) মানুষের আচরণে প্রশংসা এবং শাস্তির মত বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ।
ঘ) গভীরভাবে আত্মশৃঙ্খলার উপর জোর দিতে হবে।
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও শিক্ষকের ভূমিকা-
১) এই ধরনের দর্শনে শিক্ষকের ভূমিকা মুখ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।
২) এক্ষেত্রে শিক্ষকই হবেন শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মূল কেন্দ্র।
৩) শিক্ষকেরা নৈতিক ও ধার্মিক বিকাশে সহায়তা করবেন।
৪) শিক্ষক এখানে ঈশ্বরের সহকারী হবেন।
৫) পাশ্চাত্য দার্শনিক ফ্রয়েবেল শিক্ষককে বাগানের মালী-র সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন- "The teacher is just like a gardener who works in a garden in order to bring about the growth of plants"
ভাববাদ/আদর্শবাদ ও বিদ্যালয়-
ক) আদর্শবাদী বা ভাববাদীদের মতে বিদ্যালয়ই হল নিয়মিত এবং কার্যকরী শিক্ষার একমাত্র প্রতিষ্ঠান।
খ) এই দর্শনে বলা হয়েছে বিদ্যালয় শিশুদের জন্য মনোরম এবং আনন্দদায়ক কার্যকলাপের আদর্শ স্থান।
গ) শিক্ষার্থীরা এখানে আদর্শ শিক্ষকের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে উচ্চ আদর্শের শিক্ষা লাভ করতে পারে।
0 Comments: