
Operent Conditioning theory (সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব)
শিখনের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বের প্রবক্তা Burrhus Frederic Skinner (1904-1990) ছিলেন একজন বিখ্যাত আমেরিকান মনোবিদ্, লেখক, উদ্ভাবক, আচরণবাদী ও সমাজদার্শনিক। 1930 খ্রি. তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ছাত্রাবস্থায় National Academy of Science প্রত্রিকায় The concept of the reflex in the description of the behaviour নামক একটি প্রবন্ধে সর্বপ্রথম Operent Conditioning এর ধারণা দেন। তারপর 1935 খ্রি. Science & human Behaviour গ্রন্থে এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেন।
আচরনবাদী মনোবিজ্ঞানী B.F.Skinner তার শিখন তত্ত্বে প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তন তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেছেন প্রাণীর অনুবর্তন হয় ঠিকই, তবে অনুবর্তনে উদ্দীপকের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার সংযোগ ঘটে না। অনুবর্তনে প্রাণীর সক্রিয় মানসিক অবস্থার প্রতিক্রিয়া ঘটে। এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে তার সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্ব (Operent Conditioning theory)। এই তত্ত্বের অপর নাম Instrumental Conditioning, R-S theory, R-Type conditioning ইত্যাদি।
স্কিনারের পরীক্ষা (Experiment)- প্রথমে একটি ক্ষুধার্ত ইঁদুরকে স্কিনার বাক্সে ঢোকানো হয় এবং ট্রেতে কিছু খাবার দেওয়া হয়। তখন স্বাভাবিকভাবে ইঁদুরটি ট্রে থেকে খাবার খায়। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী স্কিনার বা ইঁদুর কেউই কিন্তু লিভারে চাপ দিয়ে খাদ্যবস্তু আনে নি। পরবর্তীতে আবার ইঁদুরকে বাক্সে ঢোকানোর পর স্কিনার নিজেই লিভার টিপে ট্রে তে খাবার আনার ব্যবস্থা করেন এবং ইঁদুরটি ওই খাবার খায়। এইভাবে স্কিনার ইঁদুরটিকে পরীক্ষামূলক পরিস্থিতির সাথে পরিচয় করান।এরপর স্কিনার মূল পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। এবার ওই ইঁদুরটিকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বাক্সে ঢোকানো হয় এবং ট্রে তে কোন খাবার দেওয়া হয় না। তখন ইঁদুরটি খাবার পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া করতে থাকে এবং একসময় ইঁদুরটি লিভারে চাপ দিয়ে ফেলে আর তৎক্ষণাৎ ট্রে তে খাবার এসে পৌঁছায় এবং সে খাবার খায়। পরে আবার ইঁদুরটিকে বাক্সে ঢুকিয়ে দিলে দেখা যায় ইঁদুরটি নিজেই লিভারে চাপ দিয়ে খাবার আনতে পারছে। অর্থাৎ ইঁদুরটির মধ্যে একটি নতুন আচরণ সৃষ্টি হচ্ছে। স্কিনার এই ধরনের প্রক্রিয়াকে বলেন সক্রিয় অনুবর্তন (Operent Conditioning)।
স্কিনার তার সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বে দুটি আচরণের কথা বলেছেন-
১. Respondent: যে জাতীয় আচরণ নির্দিষ্ট বস্তুধর্মী উদ্দীপকের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় তাকে Respondent বলে। যেমন প্যাভলভের প্রাচীন অনুবর্তনে বস্তুধর্মী উদ্দীপক খাদ্যবস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে কুকুরের লালাক্ষরণ হয়।
২. Operent: যে জাতীয় আচরণ কোন উদ্দীপকের সাহায্যে না ঘটে প্রত্যাশামূলক উদ্দীপকের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় তাকে Operent বলে। যেমন স্কিনারের পরীক্ষায় খাদ্যের প্রত্যাশায় ইঁদুরটি লিভারে চাপ দেওয়ার আচরণটি করে। এখানে খাদ্যবস্তুর (উদ্দীপকের) পরিপ্রেক্ষিতে সে এই ধরনের আচরণ করে নি।
সক্রিয় অনুবর্তনের নীতি- সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বের নীতিগুলি নিম্নে আলোচিত হল:
১) আচরণের উপাদান (Shaping)- কোন বড় ধরনের আচরণকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশের সঠিক আচরণের জন্য যদি শক্তিদায়ী উদ্দীপক প্রয়োগ করা হয় তাহলে দেখা যায় ধীরে ধীরে সমগ্র আচরণটির পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে যা শেপিং নামে পরিচিত। যেমন, পরীক্ষার আগে কোন শিক্ষার্থী সমগ্র পাঠক্রমকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পড়তে শুরু করে। তার একটি অংশ পড়া শেষ হলে সে একটু স্বস্তি বোধ করে এবং পুনরায় পরের অংশে অগ্রসর হয়।
২) শক্তিদায়ী উদ্দীপক (Reinforcement)- স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ একবার সম্পাদিত হওয়ার পর যে উদ্দীপক প্রাণীর চাহিদাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে তাই-ই হল শক্তিদায়ী উদ্দীপক। যেমন- এই পরীক্ষায় লিভারে চাপ দেওয়ার সাথে সাথে প্রথমবার খাদ্যবস্তু পাওয়ার পর ইঁদুরের আচরণের শক্তি আরও বেড়ে গিয়েছিল তাই এখানে খাদ্যবস্তু শক্তিদায়ক উদ্দীপক। এই উদ্দীপকগুলিকে তিনি মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করেছেন-
ক) ধনাত্মক শক্তিদায়ী উদ্দীপক- যে উদ্দীপক আচরণের পুনরাবৃত্তিতে প্রাণীকে অনুপ্রাণিত করে তা হল ধনাত্মক শক্তিদায়ী উদ্দীপক। যেমন, খাদ্যবস্তু ক্ষুধার্ত ইঁদুরের কাছে ধনাত্মক শক্তিদায়ী উদ্দীপক।
খ) ঋণাত্মক শক্তিদায়ী উদ্দীপক- যে উদ্দীপকগুলির বিশেষ আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প কোন আচরণ সম্পাদনে প্রাণীকে শক্তি জোগায় তাকে ঋণাত্মক শক্তিদায়ী উদ্দীপক বলা হয়। যেমন, শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে বিকল্প আচরণস্বরূপ পড়ার সময় আরও বাড়িয়ে দেয়।
গ) শাস্তিমূলক শক্তিদায়ী উদ্দীপক- যে উদ্দীপক আচরণের পুনরাবৃত্তিতে বাধা সৃষ্টি করে তাকে শাস্তিমূলক শক্তিদায়ী উদ্দীপক বলে। যেমন- দৈহিক শাস্তি।
৩) প্রবলকের সময়সূচী (Schedule of Reinforcement)- স্কিনার বলেন শক্তিদায়ী উদ্দীপক বিভিন্নভাবে প্রদান করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রবলকের সময়সূচী বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন-
i. Continuous Schedule: প্রতিটি সঠিক আচরণের পরে প্রবলক উপস্থাপন করাকে (Continuous Schedule) অবিচ্ছিন্ন সময়সূচী বলে।
ii) Fixed Ratio Schedule: এখানে নির্দিষ্ট সংখ্যক সঠিক আচরণের পর একবার করে প্রবলকের উপস্থাপন করা হয়।
iii) Fixed Interval Schedule: এখানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রবলক উপস্থাপিত হয়।
iv) Variable Ratio Schedule: এক্ষেত্রে প্রবলক কখন দেওয়া হবে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। কতবার আচরণটি করলে প্রবলক উপস্থাপন করা হবে সেটি নির্দিষ্ট নয়, পরিবর্তনশীল।
v) Variable time Schedule: এক্ষেত্রে কতক্ষণ পরে প্রবলক উপস্থাপিত হবে তা যেমন পরিবর্তনীয় তেমনি তার পূর্বানুমান করাও সম্ভব নয়।
৪) সাহায্যদান (Promt)- এটি হল এক ধরনের উদ্দীপক বা সূত্র (Clue)। যা প্রতিক্রিয়ার আগে দেওয়া হয় এবং এর জন্য প্রতিক্রিয়া করতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি প্রতিক্রিয়া করার প্রবণতাও অনেক গুণ বেড়ে যায়।
সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য- (Educational implication of Operent Conditioning theory)
শাস্তির ব্যবহারযোগ্যতা- সক্রিয় অনুবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শাস্তিদানের নীতি পরিত্যাগ, অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদানের সময় শাস্তিদানের নীতি পরিত্যাগ করে উপযুক্ত শক্তিদায়ক উদ্দীপক উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবেন।
আচরণ সংশোধন- শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষে সক্রিয়তার দরুন নতুন নতুন আচরণ সম্পাদন করে।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যদি কোন ভুল আচরণ করে তার জন্য শিক্ষককে আদর্শ শিখন পরিবেশ তৈরি করতে হবে এবং শিক্ষার্থীকে পুনরায় স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া সম্পাদনের সুযোগ করে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে কাঙ্খিত আচরণ তৈরি করা যেমন সম্ভব একইভাবে অনভিপ্রেত আচরণকেও দূর করা সম্ভব।
শক্তিদায়ী উদ্দীপক- শিশুর শিক্ষাকালীন আচরণ পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করে তুলতে হলে নতুন আচরণ সম্পাদনের সঙ্গে তাকে শক্তিদায়ী উদ্দীপক বা পুরস্কার দিতে হবে।
বৃহৎ বা জটিল আচরণকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করা- স্কিনারের সক্রিয় অনুবর্তন তত্ত্বে শেপিং হল একটি গুরুত্বপূর্ণ শিখন পদ্ধতি। যখন কোন আচরণ জটিল ও বৃহৎ হয় তখন সেই আচরণটিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশের সঠিক আচরণকে শক্তিদায়ী উদ্দীপক দিয়ে উৎসাহিত করলে পূর্ব আচরণটি তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে সুবিধা হয়।
সংকেত প্রদান- শিক্ষার্থী যখন প্রথমবার কোন আচরণের শিখন লাভ করে তখন শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি তাকে কোন সংকেত (clue) বা সাহায্য (prompt) দেয় তাহলে শিক্ষার্থীর শিখন সহজ হয় এবং সে তাড়াতাড়ি কাঙ্খিত আচরণে পৌঁছতে পারে।
প্রোগ্রাম শিখন- স্কিনারের এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই প্রোগ্রাম শিখন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এটি একটি স্বশিক্ষণ পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষার্থী শিক্ষক/শিক্ষিকার অনুপস্থিতিতেও নিজে নিজেই কোন একটি পাঠ বুঝে নিতে পারে।
0 Comments: