
পাঠ্যক্রমের দার্শনিক ভিত্তি (Philosophical bases of Curriculum)
মানুষের জীবনাদর্শ যুগে যুগে পরিবর্তিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্যেরও। ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক মতবাদ সময়ে সময়ে শিক্ষার বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করেছে। দর্শনের এই প্রভাব বিশেষভাবে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। শিক্ষার লক্ষ্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠক্রম সম্পর্কে ধারণারও পরিবর্তন ঘটেছে। আবার পাঠক্রম সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠক্রমের সাংগঠনিক কাঠামোটি কিরূপ হবে সেই বিষয়েও সিদ্ধান্তের পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন সময়ে যে জীবনাদর্শনগুলি বিশেষভাবে শিক্ষাচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে সেগুলোর মধ্যে ভাববাদী দর্শন, প্রকৃতিবাদী দর্শন ও প্রয়োগবাদী দর্শনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাঠ্যক্রম রচনার ক্ষেত্রে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি-
ভাববাদী দর্শন অনুযায়ী মানুষের জীবনের লক্ষ্য হল আত্মোপলব্ধি। আর তাই শিক্ষার লক্ষ্য জীবনের উন্নত মূল্যবোধগুলি সম্পর্কে শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা জাগ্রত করা। এই শিক্ষাদর্শনে পাঠক্রমের ব্যবহারিক দিকের উপর গুরুত্ব না দিয়ে তার তাত্ত্বিক উপযোগিতার উপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে বিষয়সমূহের তুলনায় মানবীয় জ্ঞান বা মানববিদ্যাসমূহের অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দিয়েছেন ভাববাদী দার্শনিকরা। তারা বলেছেন আধ্যাত্মিক সত্তা বা ঈশ্বরের তিন প্রকারের ক্রিয়া বর্তমান- নৈতিক ভৌতিক এবং নান্দনিক। ভাববাদী শিক্ষা দার্শনিকদের মতে শিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত অভিজ্ঞতাগুলি জ্ঞান, ভক্তি এবং কর্মের চাহিদার পরিপূরক হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিক্ষার্থীর মধ্যে বৌদ্ধিক চেতনা জাগ্রত করার জন্য ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ও বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন ভাববাদী দার্শনিকরা। আবার শিক্ষার্থীর মধ্যে নৈতিক চেতনা জাগ্রত করার জন্য তারা পাঠক্রমে কবিতা, শিল্পকলা, ধর্ম ইত্যাদির মত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। আবার শিক্ষার্থীর মনে কর্মসচেতনতা জাগ্রত করার জন্য পাঠক্রমে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, শারীরশিক্ষা, হস্তশিল্প ইত্যাদি ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন।
পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি-
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকগণ শিক্ষার জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম রচনার পক্ষপাতী ছিলেন না। তারা বলেছেন প্রত্যেক শিশুরই তার নিজস্ব ক্ষমতা ও মানসিক বৈশিষ্ট্যাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে নিজের শিক্ষার জন্য পাঠক্রম রচনা করার অধিকার থাকা উচিৎ। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। এভাবেই সে তার নিজের শিক্ষাকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করবে। তাকে কোন নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা পাঠক্রম অনুশীলন করতে বাধ্য করা হবে না। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকগণ পাঠক্রমে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন-
ভাষা ও গণিত: প্রকৃতিবাদীগণ ভাষা এবং গণিতকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। কারণ এই দুটি বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান আয়ত্ত করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে প্রকৃতিবাদীগণ পাঠক্রমে ভাষাকে শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবীয় গুণ বিকাশের উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত করেননি, ভাষাকে আত্মসংরক্ষণের পরোক্ষ প্রয়োজনীয় কৌশল হিসেবে পাঠক্রমে নির্বাচন করার কথা বলেছেন। তারা গণিতকে মানসিক গুণাবলী বিকাশের উদ্দেশ্যে অন্তর্ভুক্ত না করে তাকে বিজ্ঞান চর্চার সহায়ক হিসেবে নির্বাচন করেছেন।
প্রাকৃতিক বিজ্ঞান: পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়গুলির মত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিষয়কে এখানে অন্তর্ভুক্তি করার কথা বলা হয়েছে। এই সকল বিষয়ের অভিজ্ঞতা একদিকে যেমন প্রকৃতিকে জানতে সাহায্য করবে তেমনি অন্যদিকে শিক্ষার্থীকে আত্মসংরক্ষণেও সহায়তা করবে।
ইতিহাস ও সমাজবিদ্যা: প্রকৃতিবাদীরা বলেছেন যে কোন আধুনিক জ্ঞান সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে হলে তার বিবর্তনের ধারা ও বর্তমানের পটভূমিটি বিশেষভাবে অনুশীলন করা প্রয়োজন। ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার মতো বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষার্থীকে মানুষের বৈজ্ঞানিক চেতনার অভিব্যক্তি অনুশীলনে সহায়তা করবে এবং বর্তমান জীবনে তাদের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সহায়তা করবে। এই প্রত্যাশায় এই ধরনের বিষয়গুলিকে প্রকৃতিবাদের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কৃষিকাজ ও দারুশিল্প: প্রকৃতিবাদীগণ বলেছেন শিক্ষার্থীর মধ্যে বৈজ্ঞানিক চেতনা জাগ্রত করতে হলে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রাকৃতিক উপসর্গগুলিকে আয়ত্তে আনার ব্যাপারে তাকে সক্রিয় করে তুলতে হবে। তারা বলেছেন কৃষিকাজ এবং দারুশিল্প সংক্রান্ত কার্যাবলী শিক্ষার্থীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বৃদ্ধিতে এবং তার মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রবণতা সঞ্চারে সহায়তা করবে। তাই প্রকৃতিবাদীগণ এই দুটি বিষয়কে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন।
শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা: প্রকৃতিবাদীদের মতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে আত্মসংরক্ষণের কৌশলের শিক্ষা দিতে হবে। তাই শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে তাদেরকে সচেতন করতে হবে। প্রকৃতিবাদীরা বলেছেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বাভাবিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে অঙ্গ সঞ্চালনের সুযোগ দান করাই পাঠক্রমের এই অংশের উদ্দেশ্য। তাই এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর প্রকৃতির উদ্দীপনায় আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কৌশলগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আয়ত্ত করবে এবং নিজেকে প্রকৃতির মাঝে প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।
অঙ্কন: প্রকৃতিবাদী দার্শনিকগণ অঙ্কনকে আবশ্যিক কর্মসূচী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। কারণ তারা মনে করেন অঙ্কনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা অবাধ আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়।
প্রকৃতিবাদের পাঠক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার উপরে আলাদাভাবে কোন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি কারণ তারা ধর্মীয় শিক্ষার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। তারা বলেছেন শিশুরা নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেদের কর্ম নির্ধারণ করবে এই জাতীয় শিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বা বিশেষ প্রশিক্ষণের কোন প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করতেন না। নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারেও তারা বলেছেন শিক্ষার্থীর ওপর জোর করে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিৎ নয়। শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনপরিস্থিতিতে নিজের আচরণের জন্য প্রাকৃতিক নিয়মেই শাস্তি বা পুরস্কার লাভ করে। তারা নিজের জীবনের নৈতিক মান কি হবে তা স্থির করবে অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় প্রকৃতিবাদী শিক্ষাবিদদের দ্বারা প্রস্তাবিত শিক্ষার পাঠক্রমে শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ গড়ে তোলার জন্য কোন পরিকল্পিত কর্মসূচী রাখা হয়নি।
পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি-
প্রয়োগবাদী শিক্ষাদর্শনে শিক্ষাকে জীবন প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্ম হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রয়োগবাদীগণ সরাসরিভাবে শিক্ষার কোন নির্দিষ্ট পাঠক্রমের কাঠামো প্রস্তাব করেননি। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগবাদীগণ পাঠক্রম সম্পর্কে যে সমস্ত বিক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন তার ভিত্তিতে তাদের কল্পনার পাঠক্রমের একটি রূপরেখা তৈরি করা যায়। তাদের মতে, শিক্ষার পাঠক্রমে কেবলমাত্র সেইসকল বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ যেগুলি শিক্ষার্থীর জীবন যাপনের অন্তর্গত কার্যাবলীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন- ভাষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান, নারীদের জন্য গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, কৃষিকাজ ইত্যাদিকে তারা পাঠ্যক্রমে আবশ্যিক করার পরামর্শ দিয়েছেন ।
প্রয়োগবাদীরা পাঠ্যক্রমকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক করার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তার নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রমের অভিজ্ঞতা নির্বাচন করবে। পূর্ব নির্ধারিত কোনো ছকের দ্বারা শিক্ষার কাজ চলবে না। এই ছিল তাদের পাঠ্যক্রমের জন্য অভিজ্ঞতা নির্বাচনের মূলনীতি। প্রয়োগবাদী শিক্ষাবিদগণ পাঠ্যক্রমের সাংগঠনিক বিন্যাস সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ধারণা না দিলেও পাঠ্যক্রমের উপাদান গুলির বিন্যাসের ব্যাপারে তারা সমন্বয়ের নীতিকেই বিশেষভাবে সমর্থন করেছেন। তারা বলেছেন পাঠ্যক্রমের মধ্যে অভিজ্ঞতা গুলিকে তাদের পারস্পারিক সম্পর্কে আবদ্ধ করে উপস্থাপন করতে হবে। তাদের প্রস্তাবিত এই সমন্বয়ের নীতি আধুনিককালে শিক্ষার পাঠ্যক্রম রচনার একটি মূলনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা যেহেতু তার সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে আসে সেহেতু নির্দিষ্ট কর্মভিত্তিক অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে সমন্বয় তার পক্ষে উপযোগী। তাই প্রয়োগবাদী শিক্ষাবিদগণ পরোক্ষভাবে পাঠ্যক্রমের অভিজ্ঞতা গুলিকে কর্মকেন্দ্রিক করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিভিন্ন শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির জন্য যে সকল বিষয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সেগুলির সংখ্যা এবং প্রকৃতির মধ্যে যেমন পার্থক্য দেখা যায় তেমনি তাদের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যের মধ্যেও পার্থক্য বর্তমান। যেমন ভাববাদী শিক্ষাদর্শন অনুযায়ী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেওয়া হয়েছে কিন্তু প্রকৃতিবাদে তাকে বর্জন করা হয়েছে। ইতিহাসকে ভাববাদী শিক্ষাদর্শনে শিক্ষার্থীর ভৌতিক বিকাশের সহায়তা করার জন্য পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু প্রকৃতিবাদে ইতিহাসকে শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান চেতনা বিকাশের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার ওই একই বিষয়কে প্রয়োগবাদে শিক্ষার্থীর সামাজিক চেতনা বিকাশের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। পাঠ্যক্রমে বিষয়বস্তু সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য মূলত বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের জীবনদর্শনের পার্থক্যের দরুনই ঘটেছে। আবার পাঠ্যক্রম বিন্যাসের ক্ষেত্রে অনুরূপভাবে দার্শনিক মতবাদগুলির মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ পাঠ্যক্রমের জন্য নির্বাচিত বিষয়বস্তুগুলিকে সুবিন্যস্ত করার ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা দর্শনে ভিন্ন ভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এই জাতীয় পার্থক্য থাকায় তাদের কোন একটিকে এককভাবে পাঠক্রম রচনার মৌলিক নীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তবে তিনটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে প্রয়োগবাদী দর্শন অনেক বেশি বাস্তবনির্ভর। তাই এই দর্শনের নীতিগুলি আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রম রচনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বীকৃতি লাভ করেছে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
0 Comments: