
স্বাধীনতার পর শিক্ষাব্যবস্থার একটি সুপরিকল্পিত কাঠামো গঠন করার জন্য ভারত সরকার ১৯৬৪ সালে ইউ.জি.সি -এর চেয়ারম্যান ডঃ দৌলত সিং কোঠারীর নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেন সেটি শিক্ষার ইতিহাসে কোঠারি কমিশন বা ভারতের শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত। দেশি ও বিদেশী মোট ১৭ জন সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়। এদের মধ্যে জে. পি. নায়ক, গোপালস্বামী, টি. সেন, পি.এন. কৃপাল প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীন ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এটি তৃতীয় শিক্ষা কমিশন যার রিপোর্ট ছিল ৬৯২ পৃষ্ঠার। এই কমিশন কাজের সুবিধার জন্য ১২টি টাস্ক ফোর্স তৈরি করেন এবং ৭টি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করেন। যেগুলি শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যার পর্যালোচনা করে দীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করে।
কোঠারী কমিশনের সুপারিশগুলি নিম্নরূপ:-
১) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই কমিশনের মতে শিক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলি হল-
i) ভারতীয় সমাজে বর্তমান চাহিদা ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটানোই হবে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
ii) উৎপাদনমুখী জ্ঞান এবং দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা।
iii) শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক বিকাশ সাধন করা।
iv) পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিযোজন করানো প্রভৃতি।
২) শিক্ষার কাঠামো-
শিক্ষা কাঠামো সংক্রান্ত কোঠারী কমিশনের সুপারিশ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। কমিশন প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাস্তরের একটি সম্পূর্ণ কাঠামোর সুপারিশ করেন। কোঠারি কমিশনে শিক্ষার এই কাঠামোটি 10+2+3 নামে অধিক জনপ্রিয়।
কোঠারী কমিশনে প্রস্তাবিত শিক্ষার কাঠামোটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত -
i) প্রাথমিক শিক্ষা (৭-৮ বছরের)
ii) নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা (২-৩ বছরের)
iii) উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা (২ বছরের)
iv) উচ্চ শিক্ষা বা স্নাতক (৩ বছরের)
v) সর্বোচ্চ শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা (২ বছরের)
৩) শিক্ষার পাঠক্রম-
পাঠক্রম শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পাঠক্রম ছাড়া শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হতে পারে না। পাঠক্রম সম্পর্কে কমিশনে বলা হয়েছে পাঠক্রমকে ব্যক্তির জীবনমুখী অভিজ্ঞতার সঙ্গে ও সামাজিক চাহিদার সাথে সমন্বয় করে গড়ে তুলতে হবে। যেমন-
i) প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম- প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমকে কমিশন দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- নিম্ন প্রাথমিক স্তর ও উচ্চ প্রাথমিক স্তর।
নিম্ন প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে থাকবে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, গণিত, পরিবেশ পরিচিতি, স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি।
অন্যদিকে উচ্চ প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে থাকবে দুটি ভাষা (মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষা এবং হিন্দি অথবা ইংরেজি) গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল, কর্ম অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা ইত্যাদি।
ii) মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম- মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমকে কমিশন দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- নিম্ন মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর।
নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমে থাকবে তিনটি ভাষা (মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষা এবং হিন্দি অথবা ইংরেজি) গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, কর্ম অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা ইত্যাদি।
অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম হবে আধুনিক ভারতীয় ভাষা, আধুনিক বিদেশী ভাষা এবং প্রাচীন ভাষার মধ্যে যে কোন দুটি, এছাড়া থাকবে একটি অতিরিক্ত ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা প্রভৃতি।
৪) শিক্ষার মাধ্যম- শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে কোঠারি কমিশন মাতৃভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এছাড়া কমিশন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে 'ত্রি-ভাষা সূত্রে'র কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এই ত্রি-ভাষা সূত্রটি হল- মাতৃভাষা কিংবা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি ও ইংরেজি। অর্থাৎ তিনটি ভাষার সমন্বয়ই হল ত্রি-ভাষা সূত্র। কমিশনে আরও বলা হয়েছে পঞ্চম শ্রেণীর পূর্বে ইংরেজি ভাষা থাকবে না। অষ্টম শ্রেণীর পর থেকে ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে সংস্কৃতকে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে।
৫) নারী শিক্ষা- নারী শিক্ষার উন্নতিকল্পে কোঠারি কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে পুরুষদের সঙ্গে একত্রে নারীরা কাজ করবে। তাই নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য কমিশনের সুপারিশ হল মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়েছে নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ এর ব্যবস্থা করতে হবে। আলাদা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ করতে হবে। মেয়েদের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং মেয়েদের শিক্ষায় সমসুযোগ দিতে হবে।
৬) শিক্ষায় সমসুযোগ-
কোঠারি কমিশন গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সুযোগের সুপারিশ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে শিক্ষার লক্ষ্য হবে সকল স্তরের শিক্ষাকে অবৈতনিক গড়ে তোলা এবং এর জন্য শিক্ষায় সকলকে সমান সুযোগ দান করা।
শিক্ষার সমসুযোগের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশগুলি হল-
i) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ প্রদান।
ii) উচ্চতর মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কোন বেতন নেওয়া হবে না।
iii) আর্থিক অবস্থা এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী সকল শিশুদের জন্য শিক্ষার সর্বোত্তম সুযোগ প্রদান করা।
0 Comments: