
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History of the Indo-European Language Family)
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাষা পরিবার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে কয়েকজন ভাষা বিশারদ উপলব্ধি করলেন কিছু ইউরোপীয় ভাষার সাথে এশীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের অনেক সাদৃশ্য আছে। এই অনুমান থেকেই আবিষ্কৃত হল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের আবিষ্কার- অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষার সাদৃশ্যের সত্যানুসন্ধান শুরু হয়। স্যার উইলিয়াম জোন্স ছিলেন এই গবেষণার পথপ্রদর্শক। ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সর্বপ্রথম এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন পেশায় বিচারক এবং পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষার গবেষক।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অবস্থান- ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার একটি একান্নবর্তী পরিবার, যার বিস্তার ইউরোপের কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই কারণে মানবজাতি ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করত। মানবসমাজের এই বিক্ষিপ্ত বসবাসের পূর্বে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের বাসভূমি ছিল নর্দান ইউরোপ এবং সাউদার্ণ রাশিয়া। ইউরোপের অনেক ভাষার সাদৃশ্য পরে আবিষ্কৃত হয় এবং সেখান থেকে জানা যায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার মেডিটারনিয়ান এবং এশিয়াটিক বেল্টেও বিরাজ করত।
সভ্যতার প্রথম দিকের ইন্দো-ইউরোপীয়
জনগোষ্ঠী বালকান এবং নর্দার্ণ ইউরোপে ছড়িয়ে পরে, কালের যাত্রায় তারা ক্রমশ ইরান,
আনাতোলিয়া এবং সাউদার্ণ ইউরোপে বসবাস করতে শুরু করে। তাদের আরেকটি দল নর্থ
সেন্ট্রাল ইউরোপে বসবাস করতে থাকে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সংস্কৃতি- যে কোন ভাষা বা ভাষা পরিবারের সাথে সেই স্থানের সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সংস্কৃতি বাদ দিয়ে যেমন ভাষার জ্ঞান সম্ভব নয়, তেমনই ভাষা বাদ দিয়ে কোন স্থানের সংস্কৃতির জ্ঞান সর্বদা অসম্পূর্ণ। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের প্রথম পর্বে কুর্গান সংস্কৃতি বিরাজ করত। এই কুর্গান সংস্কৃতির উপস্থিতি অনুমান করা হয় ককেশাস এবং কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে। সেখানে যুদ্ধ ছিল মানব সম্প্রদায়ের পেশা, শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল কম। তারা আকাশ, সূর্য, ঘোড়া, সাপ ও বজ্র ইত্যাদিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। এছাড়া তারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বিশ্বাস করত। গবাদি পশু ছিল তাদের কাছে অধিক মূল্যবান, গবাদি পশুর সংখ্যার ভিত্তিতে সম্পদের হিসেব করা হত।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-
ইউরোপীয় ও এশীয় ভাষার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারকে ১১টি গ্রুপে ভাগ করা যায়-
Iranian- ভারতের উত্তরে ও ইরানের
বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তাকে
ইরানিয়ান গ্রুপ বলে।
Armenian- ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা
পরিবারের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সদস্য হল আর্মেনিয়ান ভাষা। এই ভাষা সাউথ ককেশাস
মাউন্টেন এবং ইস্টার্ন ব্ল্যাক সি-তে সর্বাধিক
ব্যবহৃত হত। এই ভাষায় ব্যাকরণবিদ্যা একেবারেই অনুপস্থিত। পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত
আর্মেনিয়ান ভাষায় অনূদিত বাইবেলের সন্ধান পাওয়া যায়।
Hellenic- হেলেনিক হল বহু
প্রাচীনকালে ব্যবহৃত একটি উপভাষা। এশিয়া মাইনর, সাইপ্রাস ও ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জে
গ্রিক ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই উপভাষাগুলির মধ্যে আত্তিক )Attic) বহুল প্রচলিত ছিল। গ্রীসের রাজধানী এথেন্স
যখন সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেছিল তখন এই আত্তিক )Attic) ধীরে ধীরে হেলেনিক ভাষার
উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। বলাবাহুল্য আত্তিক )Attic) উপভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে
বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।
Albenian- আর্মেনিয়ান ভাষার মতো
আলবেনিয়ান ভাষাটি ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর এক
ক্ষুদ্রতম অংশ। এই ভাষাটি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হত। আলবেনিয়ান
ভাষার অনেক শব্দভান্ডার ল্যাটিন, গ্রিক, তুর্কিশ এবং স্লাভানিক মিশ্রন বহন করে।
Italic- ইটালিক ভাষার উৎপত্তিস্থল হিসেবে অনেকে ইতালিকেই চিহ্নিত করেছেন । প্রাচীনকালে অনেক মানুষের কাছে ইতালি শব্দের অর্থ ছিল রোম ও রোমের ভাষা। ইটালিক ভাষা থেকে বেশ কয়েকটি বিখ্যাত ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। যেমন ল্যাটিন, এই ল্যাটিন থেকে অনেক ইউরোপীয় ভাষা পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান এবং রোমানিয়ান ইত্যাদির জন্ম হয়েছে।
Balto-Slavic- স্লাভিক ভাষাভাষীরা পোল্যান্ড ও পশ্চিম সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাস করত। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে বুলগেরিয়াতে এই ভাষা বিস্তার লাভ করেছিল।
Celtic- একসময় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সবচেয়ে বৃহৎ ও সংখ্যাবহুল ভাষা গ্রুপ ছিল কেলটিক। এই ভাষার প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় গল, স্পেন, গ্রেট ব্রিটানিয়ান, জার্মানি, নর্দান ইটালি এবং ওয়েস্টার্ন ইউরোপে।
Hittic- খ্রিস্টপূর্ব বিংশ থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে এই ভাষা প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। এশিয়া মাইনরের কাপাদোকিয়া প্রদেশের অনেকগুলি প্রত্নলেখ এই ভাষার নিদর্শন হিসেবে কাজ করে। এই ভাষাটিকে স্বতন্ত্র বলে মনে করেন অনেক ভাষাবিদ্।
Tocharian- চীনের অন্তর্গত তুর্কিস্থান থেকে তোখরীয় ভাষার সৃষ্টি। খ্রীষ্টিয় সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে এটি আবিস্কৃত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ভাষাটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
0 Comments: