
উপভাষার অর্থ ও সংজ্ঞা-
ভাষার সাথে সংস্কৃত উপসর্গ 'উপ' যুক্ত হয়ে উপভাষা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। উপ শব্দটি সমীপ্যার্থে ব্যবহৃত হয়। তাই উপভাষা মানে ভাষার কাছাকাছি/সামনে বা প্রত্যক্ষ রূপ বোঝায়। আবার ইংরেজি Dialect (উপভাষা) শব্দটি ফ্রেঞ্চ শব্দ 'Dialecte', গ্রীক শব্দ 'Dialecktos' এবং ল্যাটিন শব্দ 'Dialectus' থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ইংরেজি ভাষায় এই শব্দগুলির অর্থ 'Way of speaking' বা Local language.
উপভাষা আসলে আদর্শ ভাষারই একটি আঞ্চলিক রূপ। এই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই আদর্শ ভাষা থেকে উপভাষা কিছুটা পৃথক রূপ লাভ করেছে। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের প্রচলিত মুখের ভাষাই উপভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
উপভাষার সংজ্ঞায় প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুকুমার সেন বলেছেন- "কোন ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দলে বা অঞ্চলবিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে।"
Michael Pearce এর ভাষায়- "Dialect is a particular variety of a language which is regionally or socially distinctive."
অর্থাৎ, উপভাষা হল একটি ভাষার আঞ্চলিক রূপ, যেটি ভৌগলিকভাবে পৃথক কোন একটি অঞ্চলের ভাষাগোষ্ঠী অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর থেকে একটু আলাদা ও স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহার করে থাকে।
উপভাষার বৈশিষ্ট্য-
১) সামাজিক বা আঞ্চলিকভাবে পৃথক জনগোষ্ঠী থেকে উপভাষার আবির্ভাব ঘটে।
২) উপভাষার কোন লিখিত রূপ নেই, এটি মূলত মুখে মুখেই প্রচলিত হয়।
৩) একই ভাষার অন্তর্গত উপভাষাগুলির তথ্যরূপ আলাদা হলেও লিখিত রূপ একই হয়।
৪) উপভাষা সময়ের বিবর্তনে কখনো লুপ্ত হতে পারে আবার কখনো পূর্ণতা পেয়ে নতুন ভাষার মর্যাদা পেতে পারে।
৫) উপভাষার কোন ব্যাকরণ নেই, লিখিত রূপ নেই ঠিকই তবে উপভাষার আঞ্চলিক ভাষাতত্ত্ব ও ভৌগোলিক ভাষাতত্ত্ব নামক বিভিন্ন রূপ রয়েছে।
৬) সামাজিক বিভাগ, পেশাগত দিক, বয়স ইত্যাদি উপভাষায় ভিন্নতা এনে দেয়।
৭) উপভাষার স্বরূপ নির্দিষ্ট নয় বলে উপভাষা দ্রুত পরিবর্তনশীল।
৮) উপভাষায় কণ্ঠস্বরের ওঠানামা বা কথার টান পরিলক্ষ্যিত হয়।
৯) অর্থনৈতিক পরিকাঠামো অনেক সময় উপভাষাকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে।
১০) কোন দেশের উপভাষার মধ্যেই ভাষার মূল প্রাণশক্তি জীবিত থাকে।
উপভাষার শ্রেণীবিভাগ-
ভাষাবিদরা বহুদিন আগে থেকেই উপভাষা নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। বিভিন্ন স্থান ও অঞ্চল থেকে উপভাষা সংগ্রহ করে তারা দেখিয়েছেন একই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও আবার নানা স্তর ও পার্থক্য রয়েছে। সমাজে ভাষার এইসব জটিল রূপকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল -
ক) আঞ্চলিক উপভাষা- কখনো কখনো অঞ্চলভেদে একই ভাষার মধ্যে অল্পবিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। যেমন বাংলা ভাষার রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্গত নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান ইত্যাদি জেলার মানুষের ভাষার মধ্যে সামান্য তফাৎ পাওয়া যায়
খ) সামাজিক উপভাষা- সামাজিক স্তরভেদে একই ভাষাভাষী মানুষের কথায় কমবেশি ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন একজন অধ্যাপক, একজন রাজনৈতিক নেতা, একজন শ্রমজীবী, একজন দাগী অপরাধীর ভাষার উচ্চারণে ও শব্দ ব্যবহারে বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে। সামাজিক ভাষা আবার তিন প্রকার-
i) অপার্থ ভাষা/সংকেত ভাষা
ii) ইতর ভাষা
iii) খন্ডিত ভাষা
iv) মুন্ডমাল শব্দ
গ) সাম্প্রদায়িক উপভাষা- সমাজে উচ্চ সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষায় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষায় সংস্কৃত শব্দের আধিক্য আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ভাষায় আরবি, ফারসি, শব্দের বাহুল্য পরিলক্ষ্যিত হয়।
আদর্শ ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য-
১) আদর্শ ভাষা হল কোন ভাষার মার্জিত, পরিশীলিত ও সর্বজনগ্রাহ্য রূপ, কিন্তু উপভাষা হল আদর্শ ভাষার আঞ্চলিক রূপ।
২) আদর্শ ভাষার লিখিত রূপ ও ব্যাকরণ আছে কিন্তু উপভাষার কোন লিখিত রূপ ও ব্যাকরণ নেই।
৩) আদর্শ ভাষার বৈচিত্র্য সীমিত কিন্তু উপভাষা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ।
৪) আদর্শ ভাষার মাধ্যমে কোন সমাজ বা সভ্যতার গভীরে প্রবেশ করা যায় না কিন্তু উপভাষার মধ্য দিয়ে যে কোন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার, বিশ্বাস প্রভৃতির গভীরে প্রবেশ করা যায়।
৫) আদর্শ ভাষা মানুষ প্রয়োজনে সৃষ্টি করে কিন্তু উপভাষা সহজাতভাবেই সৃষ্টি হয়।
৬) আদর্শ ভাষা হল কোন অঞ্চলের রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষের ভাষা আর উপভাষা হল কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভাষা।
৭) আদর্শ ভাষা শিক্ষিত ও সভ্য মানুষের ভাষা কিন্তু উপভাষা শিক্ষিত ও সভ্য মানুষের ভাষা নাও হতে পারে।
৮) আদর্শ ভাষায় উচ্চারণগত কোন ত্রুটি বা বিশেষ ধরনের টান পরিলক্ষ্যিত হয় না, কিন্তু উপভাষায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব উচ্চারণ রীতি ও কোন কোন ক্ষেত্রে কথায় বিশেষ টানের ব্যবহার দেখা যায়।
৯) আদর্শ ভাষা ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কিন্তু উপভাষা ব্যবহারকারী ব্যক্তিরা সমাজের মূল স্রোত থেকে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন করেন।
১০) কোন রাজধানী অঞ্চলে আদর্শ ভাষা একটাই হয় কিন্তু কোন অঞ্চলে উপভাষা একাধিক হতে পারে।
১১) আদর্শ ভাষার একটি নির্দিষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য স্থায়ী রূপ আছে তাই আদর্শ ভাষার পরিবর্তন নেই বললেই চলে, কিন্তু উপভাষায় অন্তর্গত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকেদের ভাষা বিভিন্নরকম তাই উপভাষার স্বরূপ নির্দিষ্ট নয় বলে উপভাষা দ্রুত পরিবর্তনশীল।
১২) আদর্শ ভাষা ব্যক্তির রুচি ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় অপরদিকে উপভাষা ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ততার বিকাশ ঘটায়।
১৩) আদর্শ ভাষার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান ও মর্যাদা আছে এবং সরকারি ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি আছে। কিন্তু উপভাষার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান যেমন নেই তেমনি সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিও নেই।
শ্রেণিকক্ষে উপভাষা শিখনের প্রয়োজনীয়তা-
# উপভাষার অস্তিত্ব ও অবস্থান সম্পর্কে ধারণা দেওয়া।
# উপভাষা যে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ও সহজাত সেসম্পর্কে অবগত করা।
# উপভাষার মধ্যে তার আঞ্চলিক সংস্কৃতির রূপ আছে সেটা মনে করিয়ে দেওয়া।
# উপভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, লোকসাহিত্য, লোকগীতির জনপ্রিয়তার কথা জানিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজ উপভাষাকে সম্মান করতে শেখানো।
# আদর্শ ভাষার সঙ্গে উপভাষার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বুঝিয়ে দেওয়া।
# উপভাষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে এটির সংরক্ষণ ও সংগ্রহে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা।
# উপভাষার মধ্যেই দেশ ও সমাজের ইতিহাস বেঁচে থাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে।
0 Comments: