
ভাববাদী দর্শনের বিকল্প হিসেবে পাশ্চাত্য দেশে একটি দার্শনিক মতবাদ একসময় বিশেষভাবে চিন্তাশীল মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আলোচিত এই মতবাদকে বলা হয় প্রকৃতিবাদ বা বস্তুবাদ। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা সবকিছুকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করেন। তাদের মতে বস্তুজগৎই একমাত্র সত্য এবং জ্ঞানের উৎস। বাস্তব জগতের বাইরে কিছুই নেই। মানুষ কেবল বাস্তব জগতেরই অংশবিশেষ।
"Naturalism is that Doctrine which separates nature from God and subordinate spirit to matter."- James Ward.
প্রকৃতিবাদের প্রবক্তাগণ-
প্রকৃতিবাদের মুখ্য প্রবক্তা হিসেবে রুশো-র নাম প্রথমেই আসে। এছাড়া ডারউইন, বেকন, মন্তেসরি, হার্বার্ট স্পেন্সর, হাক্সলে, হবস, ল্যামার্ক এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সমর্থক ছিলেন।
প্রকৃতিবাদের মূল নীতি-
১) দৃশ্যমান জগৎই একমাত্র সত্য বাকি সব মিথ্যা
২) প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে না, সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী ঘটে
৩) প্রকৃতিই চিরন্তন সত্য
৪) আত্মা হল বস্তু থেকে উৎপন্ন সচেতন উপাদান
৫) মানসিক সুখের চেয়ে দৈহিক সুখই অধিকতর কাম্য
৬) সমাজের সবকিছুই কৃত্রিম তাই প্রকৃতির মধ্যে ফিরে যাও।
শিক্ষার লক্ষ্য ও প্রকৃতিবাদ-
১) জীবন সংগ্রামের শক্তি ও ক্ষমতার বিকাশ
২) মানুষকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম করে তোলা
৩) মানুষকে তার পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিবিধানে সক্ষম করে তোলা
৪) মানুষের স্বতন্ত্র বিকাশ
৫) বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সুখ প্রাপ্তি।
হার্বার্ট স্পেন্সরের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে-
i) আত্মরক্ষা
ii) জীবিকা উপার্জন
iii) প্রজনন এবং শিশু সুরক্ষা
iv) সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ
v) অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার।
প্রকৃতিবাদের শ্রেণীবিভাগ-
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা প্রকৃতিবাদের মতবাদগুলিকে মোটামুটি পাঁচটি শ্রেণীতে বিশ্লেষণ করেছেন-
ক) জড় প্রকৃতিবাদ
খ) জৈবিক প্রকৃতিবাদ
গ) যান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ
ঘ) মনোবৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদ
ঙ) কল্পনা প্রবণ প্রকৃতিবাদ।
পাঠক্রম-
প্রকৃতিবাদীদের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী বিকাশলাভ। তাই তারা কোন নির্দিষ্ট পাঠক্রমের উপর গুরুত্ব আরোপ করার পক্ষপাতি নন। তারা বলেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষালাভই হল প্রকৃত শিক্ষালাভ। তবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয় যেমন প্রকৃতি বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, কৃষি, স্বাস্থ্য, উদ্যানবিদ্যা, খেলাধুলা, সংস্কৃতি ইত্যাদি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা তারা স্বীকার করেছেন।
প্রকৃতিবাদী দার্শনিক রুশো তার 'এমিল' গ্রন্থে নিম্নলিখিত পাঠক্রমের কথা উল্লেখ করেছেন-
শৈশবকালে- শারীরিক বিকাশ, অপ্রথাগত শিক্ষা।
কৈশরকালে- ইন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ, সাঁতার, ঘোড়ায় চড়া, খেলাধুলা, দৌড়ানো, হস্তশিল্প ইত্যাদির কথা বলেছেন।
পূর্ণবয়স্কদের জন্য- প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক জ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ভাষা, গণিত, সাহিত্য, সঙ্গীত, আবেগের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কথা বলেছেন।
এছাড়া কেবলমাত্র নারীদের জন্য- সেলাই, সূচীকর্ম, জরীর কাজ, গৃহস্থালীর কাজ ইত্যাদির কথা বলেছেন।
শিক্ষণ পদ্ধতি-
শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রকৃতিবাদীরা অভিনব মতামত পোষণ করেছেন। তাদের মতে শিক্ষণ পদ্ধতি নিম্ন প্রকারের হওয়া উচিত-
১) শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে
২) শিক্ষার্থীদের কাজে তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে
৩) ব্যক্তি/শিশু যাতে নিজে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিখতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে
৪) শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, আগ্রহ ও অভীক্ষার উপর প্রকৃতিবাদীরা গুরুত্ব দিয়েছেন
৫) খেলার ছলে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা শিক্ষা লাভের কথা বলা হয়েছে
৬) নিজ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা লাভের কথাও বলা হয়েছে।
শৃঙ্খলা-
শৃঙ্খলার কথা বলতে গিয়ে প্রকৃতিবাদীরা বলেছেন- শাস্তির দ্বারা বা শিক্ষকের প্রভাব দ্বারা নয়, প্রকৃতি নিজেই একজন শিক্ষক যা মানুষকে শৃঙ্খলার পাঠ দান করে। মানুষ যখন খারাপ কাজ করে তখন প্রকৃতি নিজেই তাকে শাস্তি দেয়।
শিক্ষকের ভূমিকা-
রুশোর মতে- "Nature would have them children before they are men". অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক মানুষ হওয়ার আগে সে একটি পবিত্র শিশু একথা মাথায় রেখে শিক্ষক কাজ করবেন। শিক্ষক শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ গড়ে তুলবেন। তার চরিত্র গঠন সম্পর্কে কোন উপদেশ দেবেন না। প্রকৃতিবাদীরা শিক্ষকের প্রাধান্যকে একেবারেই গুরুত্ব দেননি তাদের মত শিক্ষক এখানে কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন এবং শিশুর সমস্ত কাজকর্মের উপর লক্ষ্য রাখবেন। শিশুকে কোন প্রকার বাধা দেবেন না, তার আগ্রহ ও চাহিদা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করতে উৎসাহী করে তুলবেন।
বিদ্যালয়-
প্রকৃতিবাদীদের মতে বিদ্যালয় হবে প্রকৃতির কোলে যেখানে প্রকৃতি নিজেই শিক্ষক হবে। বিদ্যালয়ের অবস্থান হবে শহর থেকে দূরে। বিদ্যালয়ের পুরো ব্যবস্থা শিশুদের হাতে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতিবাদীরা বিদ্যালয়ের সময়তালিকা, পরীক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদিকে একেবারেই স্বীকার করেননি।
সীমাবদ্ধতা-
প্রকৃতিবাদে একদিকে যেমন আধ্যাত্মবাদকে অস্বীকার করা হচ্ছে তেমনি শিক্ষকের ভূমিকা ও পুস্তক সংক্রান্ত অন্যান্য মাধ্যমকেও চরমভাবে বর্জন করা হয়। তাই শিশুর শিক্ষা যদি পুরোপুরি প্রকৃতির উপর ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে আশাপ্রদ ফল পাওয়া সম্ভব নয়।
0 Comments: