Pragmatism (প্রয়োগবাদ)
INFO Breaking
Live
wb_sunny

Breaking News


    প্রয়োগবাদ


    শিক্ষাজগতে প্রচলিত পাশ্চাত্য দার্শনিক মতবাদগুলির মধ্যে প্রয়োগবাদ (Pragmatism)- কে নবীনতম বলে মনে করা হয়। Pragmatism শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ Pragmatics থেকে। যার অর্থ হল কর্মঠ ও সক্ষম। সাধারণ অর্থে যা প্রয়োজনভিত্তিক বিষয় বলে পরিচিত। এই Pragmatism শব্দটি Charles Sanders Peirce ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তার 'How to make our ideas clear' নামক প্রবন্ধে প্রথম ব্যবহার করেন। তাই তাকে প্রয়োগবাদের জনক বলা হয়। তবে আমেরিকান দার্শনিক উইলিয়াম জেমস শিক্ষায় প্রয়োগবাদের সূচনা করেন। পরবর্তীকালে বিখ্যাত দার্শনিক জন ডিউই যাকে আধুনিক প্রয়োগবাদের স্রষ্ঠা বলে মনে করা হয় তিনি এই মতবাদকে বিস্তৃত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। 


    প্রয়োগবাদীরা বাস্তবতায় বিশ্বাসী, আধ্যাত্মিক জগতের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। প্রয়োগবাদের মূল কথা হল উপযোগিতা বা জীবনের দিক থেকে প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োগবাদীগণ বলেন প্রত্যক্ষ কর্মসুলভ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ নিজেই নিজের জীবনাদর্শ বা মূল্যবোধ গড়ে তোলে। তাদের মতে মানুষই সত্যের স্রষ্টা। এছাড়া পরিবেশের সামাজিক উপাদানকেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। এই দর্শন মানবজীবনের বাস্তব দিককে তুলে ধরে তাই একে মানবতাবাদী দর্শনও বলা হয়। যার উপযোগিতা আছে তাই ভালো, যা ভালো তার উপযোগিতা আছে (Utility is truth, truth is Utility).


প্রয়োগবাদের প্রবক্তাগন- 


    এই মতবাদের প্রমুখ প্রবক্তাগন হলেন চার্লস পিয়ার্স, জন ডিউই, উইলিয়াম জেমস, কিলপ্যাট্রিক, মার্গারেট প্রভৃতি দার্শনিক। 


প্রয়োগবাদী দর্শনের মূলনীতি-


i) জীবনের কোন পূর্ব নির্দিষ্ট স্থায়ী মান বা মূল্যবোধ নেই যা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। 


ii) মানুষই সত্যের স্রষ্টা। শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় বলতে কিছু নেই। চির শাশ্বত সত্য, শিব ও সুন্দরের ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার নিজের সত্যে পৌঁছয়।


iii) সত্য পরিবর্তনশীল। আমার কাছে যা সত্য তা অন্যের কাছে সত্য নাও হতে পারে। 


iv) পরিবেশের সঙ্গে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়, পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে ব্যক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। মানুষ নিষ্ক্রিয়ভাবে পরিবেশের প্রভাব মেনে নেয় না। প্রয়োজনে পরিবেশকেও পরিবর্তন করতে সচেষ্ট হয়। 


v) প্রয়োগবাদীরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন ব্যক্তিত্বের বিকাশ শুধুমাত্র সামাজিক পরিবেশেই সম্ভব। 


vi) উপযোগিতা হল এখানে মূল বিচার্য বিষয়। যে কাজের উপযোগিতা আছে শুধুমাত্র তাই গ্রহণযোগ্য। 


শিক্ষার লক্ষ্য ও প্রয়োগবাদ-


i) শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাবে। 


ii) শিক্ষার লক্ষ্য হবে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা। 


iii) শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুকে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনে সক্ষম করে তোলা, যাতে তারা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। 


iv) শিক্ষা শিশুকে সমস্যার সমাধান করতে শেখাবে এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত করবে।


পাঠক্রম-


    শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে যেমন প্রয়োগবাদী শিক্ষা দার্শনিকগণ নির্দিষ্ট দিকনির্দেশ করেননি তেমনি শিক্ষার পাঠক্রম কেমন হবে সে সম্পর্কেও তারা সুনির্দিষ্ট বিষয় তালিকা প্রস্তাব করেননি। তবে আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রমে কি কি মৌলিক বিশিষ্ট থাকা উচিৎ সে বিষয়ে প্রয়োগবাদীগণ তাদের মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে পাঠক্রম হবে অখন্ড একটি একক। শিশুর আগ্রহ ও সমাজের চাহিদার উপর ভিত্তি করে পাঠক্রম প্রস্তুত করতে হবে। প্রয়োজনে তাকে পরিবর্তনও করতে হবে। অর্থাৎ পাঠক্রম হবে পরিবর্তনশীল ও নমনীয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের উপযোগী বিষয়গুলিকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেমন-


প্রাথমিক পর্যায়ে: লেখা, পড়া, প্রকৃতি পাঠ, ছবি আঁকা, হাতের কাজ ইত্যাদি। 


পরবর্তী পর্যায়: ভাষা, সমাজবিজ্ঞান, প্রকৃতি বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, কৃষ্টি, শিল্প ও বৃত্তিমূলক কাজ। 


নান্দনিক ক্রিয়াকলাপ: সৃজনশীল কাজকর্ম, চারুশিল্প ও সঙ্গীত ইত্যাদি। 


এছাড়া মেয়েদের জন্য থাকবে গার্হস্থ্যবিজ্ঞান। 


শিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রয়োগবাদ- 


    শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণার বিকল্প হিসেবে প্রয়োগবাদে এক নতুন ধারণার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রয়োগবাদের মূল কথা হল জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার উপযোগিতা। যার দ্বারা জীবনাদর্শ তৈরি হবে। তাদের মতে-


১) শিক্ষার পদ্ধতি হবে কর্মকেন্দ্রিক, শিশুরা কাজের মধ্য দিয়ে শিখবে।


২) সমস্যা সমাধান পদ্ধতি।


৩) প্রকল্প পদ্ধতি।


৪) আত্ম সক্রিয়তা। 


শৃঙ্খলা- 


    প্রয়োগবাদী শিক্ষা দর্শনে শিক্ষার্থীদের আচরণের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে পৃথকভাবে কোন নীতি গ্রহণ করা হয়নি। প্রয়োগবাদীগণ মনে করেন যেখানে আগ্রহ আছে যেখানে আচরণগত শৃঙ্খলা স্বাভাবিক নিয়মেই বজায় থাকবে। অর্থাৎ মূল সমস্যাটি হল আগ্রহ সৃষ্টির সমস্যা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি নির্দিষ্ট কর্মের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় তবেই সে কাজ সম্পাদন করার সময় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করবে। শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য এর অতিরিক্ত কৌশল ব্যবহারের কোন প্রয়োজন নেই।


শিক্ষকের ভুমিকা- 


    প্রয়োগবাদী দর্শন অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব গতানুগতিকভাবে পাঠ্য বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা নয়। শিক্ষার্থীরা আত্ম-সক্রিয়তায় পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কর্ম সম্পাদন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। সুতরাং এই পটভূমিতে শিক্ষকের দায়িত্বেরও পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক-

i) শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য হবে শিশুর জন্য আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা।


ii) শিক্ষককে এখানে সক্রিয় পর্যবেক্ষক এবং নির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে হবে।


iii) শিশুকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে হবে। 


iv) শিক্ষার্থীকে প্রত্যক্ষভাবে কর্ম সম্পাদনের সুযোগ করে দিয়ে জীবনের প্রয়োজনীয় কৌশলগুলি আয়ত্ত করতে সহায়তা করতে হবে। 


আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ- 


    প্রয়োগবাদীরা মনে করেন ব্যক্তির বিকাশ পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা হয় না, সমাজ পরিবেশে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়। এই কারণে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ রচনার জন্য শিক্ষালয়কে সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। শিক্ষালয়ে ও সমাজের মধ্যে বসবাস করার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থী স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল গুণগুলি আয়ত্ত করতে সক্ষম হবে। শিক্ষালয়ের এই সংগঠনিক রূপ শিক্ষার্থীদের অভিযোজন কৌশল আয়ত্ত করতে সহায়তা করবে। প্রয়োগবাদী দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন প্রতিটি শিক্ষালয় হবে শুদ্ধ, সরল এবং সুসমন্বয়িত সমাজ। 


সীমাবদ্ধতা- 


    প্রয়োগবাদ কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষণকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করায় শিক্ষা মানুষের কাছে একান্ত ভাবে প্রয়োজনভিত্তিক হয়ে পড়েছে। ফলে এই ধরনের শিক্ষার ব্যবহারিক জীবনে উপযোগিতা থাকলেও এর মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক ও কৃষ্টিগত জীবনের উন্নতি সম্ভব নয়।


    এই দার্শনিক মতবাদ শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চাহিদা, ক্ষমতা ও আগ্রহ ইত্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এটি প্রকৃতিবাদী দর্শনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিকে আরও সুদৃঢ় করেছে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক জীবনধারাকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে প্রয়োগবাদ শিক্ষার সামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছে। এছাড়া কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তনের স্বপক্ষে যুক্তি স্থাপন করে শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কাছে উপযোগী করে তোলার প্রয়াস করেছে। 

0 Comments: