.jpeg)
ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষার ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমি (Historical background of Sanskrit language in India)
ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষার ঐতিহাসিক পৃষ্ঠভূমি-
"অনাদিনিধনা নিত্যা বাগুৎসৃষ্ট স্বয়ম্ভুবা।
আদৌ বেদময়ী দিব্যা যত সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ।।"
ভারতীয় বিশ্বাসানুসারে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মুখ থেকেই বেদময়ী সংস্কৃতবাণী নির্গত হয়েছে। সেই কারণে সংস্কৃত ভাষা বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষারূপে খ্যাত। সংস্কৃত ভাষাতেই বৈদিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য অতি প্রাচীন। বৈদিক পরম্পরানুসারে সর্বপ্রাচীন বেদ হল ঋক্বেদ। ম্যাক্সমুলারের মতানুসারে ঋকবেদের বেশ কিছু মন্ত্র খ্রী. পূ ২০০০ বছর পূর্বে রচিত। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলকের মতানুসারে ঋকবেদের মন্ত্রসমূহ প্রায় খ্রী. পৃ. ৪৫০০ বছর পূর্বে রচিত। অনেক পাশ্চাত্য এবং ভারতীয় পণ্ডিতেরা মনে করেন যে ঋকবেদ ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে রচিত গ্রন্থ। জার্মান পণ্ডিত ভিস্তারনিৎসও বলেছেন যে ঋকবেদ প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে রচিত হয়েছে। যাইহোক, এই সমস্ত তথ্য প্রমাণ করে বহু শতাব্দী পূর্বেই সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি ও প্রয়োগ হয়েছে। ওই সময় থেকেই সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান পদ্ধতিও প্রচলিত হয়েছে।
প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি হলেও পরবর্তীকালে এই ভাষার বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। সংস্কৃত ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্যের দুটি ভাগ লক্ষিত হয়। প্রথমটি, বৈদিক ভাষা ও সাহিত্য এবং দ্বিতীয়টি লৌকিক ভাষা ও সাহিত্য। বৈদিককালে ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষা এবং সেই ভাষায় রচিত সাহিত্য বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। বেদ পরবর্তী সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য হল লৌকিক সাহিত্য।
এই লৌকিক সাহিত্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল পুরাণ, ধর্মশাস্ত্র, ব্যাকরণশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, কোষ, গণিত, জ্যোতিষ, মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য, শ্রব্যকাব্য-দৃশ্যকাব্য, গদ্যকাব্য, পদ্যকাব্য চম্পূকাব্য, নীতিকাব্য প্রভৃতি।
বৈদিক ও লৌকিক ভেদে দুই ধারায় বিস্তৃত সংস্কৃত ভাষার আবার ভাষাতাত্ত্বিক স্তরভেদও বিদ্যমান। ভাষার ধ্বনিগত ও রূপগত পরিবর্তনানুসারে সংস্কৃত ভাষার স্তরভেদ করা হয়েছে। বিশ্বের ভাষা পরিবারসমূহের মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার অন্যতম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষারই অপর নাম আর্য ভাষা। মূল ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য ভাষায় লিখিত গ্রন্থ বা সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই ভাষাবংশেরই অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষার মধ্যে অন্যতম হল সংস্কৃত ভাষা। ধ্বনিগত ও রূপগতভাবে সংস্কৃত ভাষায় যে স্তরভেদের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তা মূলত এই আর্য ভাষাবংশেরই স্তরভেদ। সেই স্তরভেদ মূলত তিনটি। যথা-
প্রথম স্তর : (প্রাচীন ভারতীয় ভাষা বা Old-Indo Aryan Language)- এই স্তরটির কালগত সীমা আনুমানিক ১৫০০ খ্রী. পূ. থেকে ৬০০ খ্রী. পূর্বাব্দ। এই স্তরের ভাষা বৈদিক সংস্কৃত ভাষা যার মূল নিদর্শন বৈদিক গ্রন্থসমূহ।
দ্বিতীয় স্তর : (মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা বা Middle Indo-Aryan Language)- এই স্তরের সীমা আনুমানিক ৬০০ খ্রী. থেকে ৯০০ খ্রী. পূর্বাব্দ পর্যন্ত। বিভিন্ন শিলালেখ, মহাকাব্যাদি সাহিত্য গ্রন্থ এই স্তরের ভাষাগত নিদর্শন।
তৃতীয় স্তর : (নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা বা New Indo-Aryan Language)- এই স্তরের সময়সীমা শুরু আনুমানিক ৯০০খ্রী. থেকে যা বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরে অবশ্য সংস্কৃতভাষা থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন লৌকিক ভাষা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, যেমন—বাংলা, ওড়িয়া, মারাঠী, পাঞ্জাবী, অসমীয়া প্ৰভৃতি।
এইভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা সংস্কৃত ভাষার এক সুদূরপ্রসারী ইতিহাস লক্ষ্য করি। বর্তমান কাল অবধি এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি। প্রাচীনকালে সংস্কৃত শুধুমাত্র সাহিত্যিক ভাষা নয়, সাধারণের কথ্যভাষাও ছিল। বর্তমানে সংস্কৃতের এই কথ্য প্রয়োগ বহুলভাবে প্রচলিত না থাকলেও সংস্কৃত বাঙ্ময়ের চর্চা সমান তালে হয়ে চলেছে।
0 Comments: