পাঠক্রমের প্রকৃতি ও পরিধি (Nature and Scope of Curriculum)
INFO Breaking
Live
wb_sunny

Breaking News

পাঠক্রমের প্রকৃতি ও পরিধি (Nature and Scope of Curriculum)

পাঠক্রমের প্রকৃতি ও পরিধি (Nature and Scope of Curriculum)



পাঠক্রমের প্রকৃতি 

শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পাঠক্রম। সমাজ ও রাষ্ট্রভেদে পাঠক্রমের প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য ও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উপাদানের প্রভাবে পাঠক্রমের তারতম্য ঘটে থাকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠক্রমের প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটে থাকে। নীচে সাধারণভাবে পাঠক্রমের প্রকৃতি সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নীচে আলোচনা করা হল-

(১) ধারাবাহিক প্রক্রিয়া- পাঠক্রম একটি অন্তহীন ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিক্ষা বা পাঠক্রমের কতকগুলি উদ্দেশ্য আছে এবং পাঠক্রম হল এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌছানোর পথ। এটি একটি দ্বিমুখী ও যৌথ প্রক্রিয়া। যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।

(২) ব্যাপক ও বিস্তৃত- বর্তমানে শিক্ষার ধারণার সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্যেরও বিস্তৃতি ঘটেছে। তাই পাঠক্রমেরও ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। পাঠক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক সমস্ত প্রকার কার্যাবলী পাঠক্রমের ধারণার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

(৩) বহুমুখী প্রক্রিয়া- শিক্ষা হল একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। তাই শিক্ষার একটি উপাদান রূপে পাঠক্রমকেও বহুমুখী করা হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রশাসন, পিতামাতা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য উপাদান এর সঙ্গে যুক্ত।

(৪) বৈচিত্র্যপূর্ণ- শিক্ষার মূলে রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজ। ব্যক্তি ও সমাজভেদে চাহিদার তারতম্য ঘটে। এই চাহিদা ও সমস্যার তারতম্যে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের পাঠক্রম, বিভিন্ন সমাজের জন্য বিভিন্ন ধরনের পাঠক্রম নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমাজভেদে পাঠক্রমের তারতম্য ঘটেছে যা বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ।

(৫) গতিশীল- সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদার পরিবর্তন ঘটে। ফলে পাঠক্রমের প্রকৃতিও বদলে যায়। তাই পাঠক্রম হল গতিশীল প্রক্রিয়া।

(৬) সময়সাপেক্ষ- পাঠক্রমের সঙ্গে কতকগুলি পর্যায় যুক্ত থাকে। যেমন পাঠক্রমের উদ্দেশ্য নির্ধারণ, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু নির্ধারণ, বিষয়বস্তুর বিন্যাস, শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারণ ও পাঠক্রমের মূল্যায়নের উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণ প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে থাকে। এরজন্য অনেক সময় প্রয়োজন হয়।

(৭) কতকগুলি বিষয়ের সমষ্টি- পাঠক্রম একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার স্তরের জন্য রচনা করা হয়। ওই স্তরের শিক্ষার লক্ষ্যের ও উদ্দেশ্যের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কতকগুলি বিষয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিটি বিষয় পাঠক্রমের এক একটি উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। এই অর্থে পাঠক্রম হল নির্ধারিত জ্ঞানের সমষ্টি।

(৮) প্রয়োগমূলক প্রক্রিয়া- পাঠক্রম নির্মাণের পর সেটিকে কার্যকারী করার পরিকল্পনা করা হয়। পাঠক্রমের প্রয়োগ ঘটে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মিথস্ক্রিয়া বা মানসিক আদান প্রদানের মাধ্যমে। পাঠক্রম শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ পরিকল্পনা, পরিকল্পনাভিত্তিক পাঠক্রম কার্যকর করার ধারাবাহিক পদক্ষেপ এবং এর মূল্যায়ন এই তিনটি প্রক্রিয়া পাঠক্রম নির্মাণ ও পাঠক্রম উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।

(৯) ব্যক্তি ও সমাজের উন্নয়ন- শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্যক্তি ও সমাজ। আর শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ। তাই বলা যায় আধুনিক পাঠক্রম ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতির সহায়ক।

(১০) উপযোগী- আধুনিক পাঠক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল উপযোগিতার দিক। পাঠক্রম ব্যক্তি ও সমাজের চাহিদা পূরণ করে। ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধনে সাহায্য করে থাকে। অর্থাৎ পাঠক্রমের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম। পাঠক্রম শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে থাকে।

পাঠক্রমের পরিধি 

শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল পাঠক্রম। পাঠক্রমকে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। পাঠক্রমকে এককথায় শিক্ষার প্রধান চালিকাশক্তিও বলা চলে। পাঠক্রমের পরিধি বলতে বোঝায় পাঠক্রমের আলোচনার ক্ষেত্র অর্থাৎ পাঠক্রম কোন্ কোন্ বিষয় আলোচনা করে থাকে, কোন্ কোন্ বিষয় পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ইত্যাদি। নীচে পাঠক্রমের পরিধি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

(ক) বিশ্লেষণ ও চাহিদা নিরূপণে- শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিবেশ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ যেগুলি বিশ্লেষণ ছাড়া উপযুক্ত পাঠক্রম রচনা করা সম্ভব নয়। আর শিক্ষার্থীদের চাহিদা সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করতে হলে মনোবিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হয়। কারণ মনোবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জীবন বিকাশের স্তর। বিভিন্ন স্তরের বৈশিষ্ট্য ও জীবনবিকাশের বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের চাহিদা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ কোন্ স্তরের পাঠক্রম রচিত হবে এবং উক্ত স্তরের শিক্ষার্থীদের চাহিদা যথাযথভাবে নিরূপণ করতে গেলে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিবেশ সম্বন্ধে জানার জন্য সমাজতত্ত্বের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সুতরাং বলা যায় যে পাঠক্রম বিদ্যালয়ের আস্থা বিশ্লেষণ ও শিক্ষার্থীদের চাহিদা নিরূপণের বিষয়ে আলোচনা করে এবং এই বিষয়গুলি আলোচনা করতে গিয়ে মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের আলোচনাও চলে আসে।

(খ) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি- পাঠক্রম রচনার একটি মৌলিক উপাদান হল শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আসলে পাঠক্রম হল শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে উপনীত হবার পথ বা উপায়। শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে বাদ দিয়ে পাঠক্রম নির্মাণ করা সম্ভব নয়। তাই পাঠক্রমের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্ত। আর শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে সমাজতত্ত্ব ও দর্শন গভীরভাবে প্রভাবিত করে। 

(গ) পাঠক্রমের ভিত্তিতে- পাঠক্রম চর্চার একটি বিশেষ আলোচনার দিক হল পাঠক্রমের ভিত্তি। পাঠক্রমের অনেকগুলি ভিত্তি আছে- দার্শনিক ভিত্তি, সামাজিক ভিত্তি, অর্থনৈতিক ভিত্তি, ঐতিহাসিক ভিত্তি, প্রযুক্তিগত ভিত্তি, মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি ইত্যাদি। পাঠক্রমের পরিধির মধ্যে এই ভিত্তিগুলিও রয়েছে।

(ঘ) বিষয়বস্তুর নির্বাচন ও বিন্যাসে- পাঠক্রম রচনার অপর একটি উপাদান হল বিষয়বস্তুর নির্বাচন ও বিন্যাস। পাঠক্রম হল কতকগুলি বিষয়বস্তুর সমষ্টি এবং তার সুবিন্যাস। শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য কোন্ কোন্ বিষয়গুলি নির্বাচন করা হবে এবং সেগুলি কীভাবে বিন্যস্ত করা হবে সেগুলি সম্পর্কে পাঠক্রম চর্চায় আলোচনা করা হয়।

(ঙ) শিক্ষা পদ্ধতিতে- পাঠক্রম চর্চার আর একটি বিশেষ দিক হল শিক্ষা পদ্ধতি। পাঠক্রম রচনার পরবর্তী ধাপ হল সেই পাঠক্রমের শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করা। পাঠক্রমের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত হয় শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে। শ্রেণিকক্ষে পাঠক্রম উপস্থাপনের প্রশ্নে চলে আসে উপযুক্ত কৌশল পদ্ধতি নির্বাচন। পাঠক্রম চর্চায় বিভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষণের নীতি, শিক্ষণের তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। 

(চ) শিখন সম্পদ বা শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ ব্যবহারে- পাঠক্রমের প্রয়োগের সঙ্গে আর একটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটি হল শিখন সম্পদ বা শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ। পাঠক্রমটি কার্যকারীভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ প্রয়োজন হয়। বর্তমান সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তি নির্ভর। তাই পাঠক্রম চর্চায় বিভিন্ন শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ ও শিক্ষা প্রযুক্তিবিদ্যা বা যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

(ছ) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে- পাঠক্রম রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মূল্যায়ন। তাই পাঠক্রমে মূল্যায়ন, মূল্যায়নের বিভিন্ন কৌশল, মূল্যায়নের বিভিন্ন প্রকার ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

0 Comments: