
কোন বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করাই হল বাস্তববাদ। বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ অনুযায়ী এই জগতের সব কিছু সার্বিক এবং সত্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ দর্শন প্রয়োগবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এই দর্শন গতিশীল এবং এখানে বস্তুগত বিষয়ে যথার্থতা নির্ণয় করা হয়ে থাকে। এই দার্শনিক মতামত অনুযায়ী কোন বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানা বা না জানার উপর নির্ভর করে না।
ইংরাজি 'Realism' শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল বস্তুবাদ বা বাস্তববাদ। বাস্তববাদ হল এমন একটি মতবাদ যেখানে বস্তুর অস্তিত্বকে বর্তমান প্রাসঙ্গিকতার উপর ভিত্তি করে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।
এই মতবাদে বিশ্বাসী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইরাসমাস, জন লক, বেকন, রাসেল প্রমুখ।
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদী দার্শনিকগণ বাস্তববাদ বা বস্তুবাদের যে সমস্ত সংজ্ঞা দিয়েছেন তার মধ্যে কয়েকটি হল-
J.S. Ross এর মতে, বস্তুবাদ বা বাস্তববাদের মূল ভিত্তি লক্ষ্য করা যায় বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে যোগাযোগ প্রত্যক্ষনের মাধ্যমে।
দার্শনিক রামতীর্থ বলেছেন, বস্তুবাদ বা বাস্তববাদ হল এমন একটি বিশ্বাসমূলক তথ্য যেখানে বিশ্বের সমস্ত কিছু ঘটনা বা বিষয়কে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা হয়ে থাকে।
বাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি-
১) বাস্তব জগৎ একমাত্র সত্য।
২) ভাববাদ এর বিপরীত মতাদর্শ অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস করা হয় না।
৩) সমস্ত বিষয়ে সত্য অর্থাৎ কোন বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানা বা না জানার উপর নির্ভর করে না।
৪) সংবেদন হল জ্ঞান অর্জনের প্রধান চাবিকাঠি।
৫) মানুষ হল বস্তুজগতের একটি অংশ মাত্র।
৬) এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
শিক্ষায় বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ এর প্রভাব-
শিক্ষার লক্ষ্য-
শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করা।
প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করা।
শিশুকে বাস্তব জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা ও বিভিন্ন বাহ্যিক বস্তুর সহিত শিশুর পরিচিতি লাভ করানো।
পাঠক্রম-
এই দার্শনিক মতবাদ অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষার পাঠক্রম রচনা করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে শিশু বাহ্যিক জগতের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারে।
বিভিন্ন বস্তুবাদী দার্শনিক পাঠক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমের প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে মাতৃভাষা ও বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া বস্তুবাদী শিক্ষা দর্শনে পাঠক্রমের মূল ভিত্তি হবে শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা।
শিক্ষাদান পদ্ধতি-
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদী দার্শনিকগণ পুঁথিগত জ্ঞান অর্জনের প্রতি সম্পূর্ণ বিরোধী। এই মতামত অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জন করবে বাহ্যিক জগতের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
তাই বস্তুবাদ দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশিষ্ট বাস্তববাদী দার্শনিক মিলটন শিশুদের শিখন এর ক্ষেত্রে ভ্রমণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সুতরাং বাস্তববাদী শিক্ষার মূল শিক্ষাদান পদ্ধতি হল শিক্ষার্থীদের জীবনমুখী শিক্ষাদান করা।
শিক্ষক-
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ অনুযায়ী শিক্ষকের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হবে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক বিষয়বস্তু সরবরাহ করবেন অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক তার জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান সরবরাহ করবেন। তাই বস্তুবাদ অনুযায়ী শিক্ষকের প্রধান ভূমিকা হল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে যথাযথ শিক্ষাদান করা।
উপসংহার-
পরিশেষে একথা বলা যায় বস্তুবাদী বা বাস্তববাদী শিক্ষাদর্শন আধুনিকতম দর্শন। যেখানে বস্তুবাদীরা শিক্ষার ব্যবহারিক ও প্রয়োগগত দিক থেকে তুলে ধরতে চেয়েছেন যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যথাযথ চাহিদাগুলির পূরণ করা সম্ভবপর হবে। ফলে সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীরা পরিবেশের সাথে সার্থক অভিযোজন করতে সক্ষম হবে তাই বাস্তববাদ বা বস্তুবাদ আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
0 Comments: